যেভাবে টিকে গেল অনিয়মে ভরা এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের আইপিও

সম্পদের মালিকানা ও সম্পদমূল্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অনুমোদনের পর এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও স্থগিত করে দিয়েছিল শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পাশাপাশি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে দুই সদস্যের কমিটিও গঠন করেছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে অবশেষে কোম্পানিটির আইপিও’র স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিল সংস্থাটি।জানা গেছে, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন পাওয়া এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের স্থায়ী সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম খুঁজে পায় বিএসইসি। এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলও (এফআরসি) খুঁজে পায় নানা অপকর্ম। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করতে এতোটাই অনিয়ম করেছে যে, যা কোম্পানিটির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বাতিলের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই অবস্থায় আইপিও বাতিল ঠেকাতে অবৈধ পথে নেমেছিল এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সরাসরি কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএসইসিকে পক্ষে আনতে নানাভাবে লবিংও করেছেন তিনি। অবশেষে সফলতাও পেয়েছেন।সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ২সিসি এর অধীনে ১১ নং শর্তে বলা হয়েছে, আইপিও আবেদনে যেকোন ধরনের মিথ্যা তথ্য প্রদান আইপিও বাতিল হওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। এছাড়া আবেদনের ২৫ শতাংশ অর্থ বা শেয়ার ক্ষতিপূরণন দেবে। যা বিএসইসির হিসাবে জমা করা হবে। এছাড়াও আইন দ্ধারা অন্যান্য শাস্তি প্রদান করা হতে পারে।এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের অসংখ্য অনিয়ম ও মিথ্যা তথ্যের কারণে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ২সিসি এর অধীনে ১১ নং শর্ত অনুযায়ি আইপিও বাতিলের যোগ্য। এছাড়া সম্প্রতি বিএসইসি এমন অনিয়মের কারণে কিছু কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিলও করেছে।এফআরসির তদন্তে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের সম্পদ অতিমূল্যায়িতসহ আর্থিক হিসাবে নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সম্পদ বাড়িয়ে দেখানোর জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এছাড়া কোম্পানির চলতি সম্পদ, আয়, মুনাফা ও শেয়ার মানি ডিপোজিট নিয়ে অসঙ্গতি পেয়েছে। যা বিএসইসিকে অবহিত করে।বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, তদন্তে যদি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের ভূয়া সম্পদের প্রমাণ পায়, তারপরেও কোম্পানিটিকে আইপিওতে সামনে এগিয়ে নেওয়া ঠিক হয়নি। এমনিতেই কোম্পানিটি এখন অনেক বিতর্কিত। এরপরেও আইপিও চলমান রাখায় কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। যেখানে এরইমধ্যে লবিং করার খবর বেরিয়ে গিয়েছিল। তাই অতিতের ন্যায় নিজেদের স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য আইপিও বাতিল করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই কমিশনের বুদ্ধিমানের কাজ ছিল।জানা গেছে, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ কর্তৃপক্ষ বুক বিল্ডিংয়ে উচ্চ দর পেতে এবং বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ভূয়া সম্পত্তি দেখিয়েছে। যা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের মাধ্যমে নিজেদের শেয়ারধারণও বাড়িয়ে দিয়েছে।এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ প্রসপেক্টাসে কোটি কোটি টাকার ভূয়া সম্পত্তি দেখানো হয়েছে। বেশি দামে রেজিস্ট্রি, পূণ:মূল্যায়নের মাধ্যমে অতিরঞ্জিত, অস্বাভাবিক জমি উন্নয়ন ব্যয়সহ বিভিন্নভাবে সম্পদ বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে এই গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। যে রিপোর্ট বিএসইসির তদন্ত কমিটি জমা দিয়েছে।বিদ্যমান পাবলিক ইস্যু রুলস অনুযায়ি, বুক বিল্ডিংয়ে পদ্ধতিতে কাট-অফ প্রাইস নির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রাখে কোম্পানির সম্পদ। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতেই ভূয়া সম্পত্তি দেখিয়েছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ কর্তৃপক্ষ। যার মাধ্যমে খুবই অপরিচিত এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের ৫০ টাকার মতো কাট-অফ প্রাইস নির্ধারিত হয়েছে। অথচ এই কোম্পানির নাম এবং ওষুধ বাজারে আছে, তা জানেই না মানুষ।কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে প্লেসমেন্ট গ্যাংয়ের সদস্য ফরিদের নেতৃত্ব। যার সঙ্গে কাজ করে ইউনুসুর রহমান, কাজী সাইফুর রহমানসহ অন্যান্যরা। তারা এশিয়াটিকে অনেক টাকার প্লেসমেন্ট বাণিজ্য করেছে। কিন্তু কোম্পানিটির আইপিও স্থগিত হওয়ায় বিপদে পড়ে। এই অবস্থায় কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে খরচ করে কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আসার পথ পরিস্কার করতে উদ্যোগ নিয়েছিল।জানা গেছে, বিএসইসির তদন্ত কমিটি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের বিষয়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। যেখানে বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা অনুসন্ধানে কমিশন তদন্ত কমিটি গঠন করে। যা কোম্পানিটির আইপিওতে আবেদন গ্রহনের ঠিক আগের দিন। যা সমাধানের জন্য আবেদন গ্রহণ স্থগিত করা হয়।কিন্তু এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের চক্রটি বিএসইসির সেই তদন্ত কার্যক্রমও স্থগিত করে দেওয়ার জন্য জোর তৎপর চালিয়েছিল। তবে শিবলী কমিশনের স্বচ্ছতার কাছে তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত করা সম্ভব হয়নি। সেই চক্রটিই শেয়ারবাজারের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে অবৈধ উপায়ে আইপিও বাতিল ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের সম্পত্তি নিয়ে প্রতারণার বিষয়টি খুবই গুরুতর বলে জানিয়েছেন বিএসইসির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যা কোনভাবেই কোম্পানিটির আইপিও দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। বরং প্রতারণার দায়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষসহ ইস্যু ম্যানেজারের নামে মামলা করা উচিত। একইসঙ্গে আর্থিক জরিমানা ও শেয়ারবাজারে আজীবন নিষিদ্ধ করা দরকার। তাহলে অন্যরাও অপকর্ম করা থেকে দূরে সরে আসবে। অন্যথায় এই বাজারকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।