উত্তরা ফাইন্যান্সের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত

Date: 2022-12-27 20:00:08
উত্তরা ফাইন্যান্সের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত
: নানা অনিয়মের কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন পাওয়া গেছে। দু-এক দিনের মধ্যে পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই অনিয়মের কারণে গত ২৩ জুন তৎকালীন এমডি এসএম শামসুল আরেফিনকে অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।উত্তরা ফাইন্যান্স পরিচালিত হয়ে আসছে মূলত উত্তরা গ্রুপের কর্তৃত্বে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীর ওপর পরিদর্শন করে আমানতকারীদের অর্থ নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার বিভিন্ন তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতের টাকা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা না করা, কলমানির টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে পরিচালকের ব্যক্তিগত কাজে খাটানো, অগ্রিম ও প্রি-পেমেন্টের নামে নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ বের করাসহ অন্তত ৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে। প্রতিষ্ঠানটির তখনকার এমডি ও কয়েকজন পরিচালক মিলে এ অনিয়ম করেন। ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি সমকালে ‘আমানতের অর্থে উত্তরা ফিন্যান্সের স্বেচ্ছাচার’ শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে উত্তরা ফাইন্যান্সের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে বর্তমান পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া হবে। তিনি জানান, নতুন পরিচালনা পর্ষদে আপাতত সবাই হবেন স্বতন্ত্র পরিচালক। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দেওয়া স্বতন্ত্র পরিচালকের প্যানেল থেকে পর্ষদ গঠন করা হবে। এর পর প্রতিষ্ঠানটিতে আরও কোনো জালিয়াতি ঘটেছে কিনা তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হবে।উত্তরা ফাইন্যান্সের আট সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান চেয়ারম্যান রাশেদুল হাসান এবং ভাইস চেয়ারম্যান মতিউর রহমান। এ ছাড়া পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জাকিয়া রহমান, তাহমিনা রহমান, নাঈমুর রহমান ও কাজী ইমদাদ হাসান। আর স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে রয়েছেন এএস জহির মুহাম্মদ ও মায়া রানী রায়। বর্তমান পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠনের জন্য সম্প্রতি বিএসইসির কাছে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন পেশায় অভিজ্ঞ ১২ সদস্যের নাম প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফরহাত আনোয়ারকে চেয়ারম্যান পদে প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পেশায় অভিজ্ঞদের নাম রয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তরা ফিন্যান্সের ২০১৯ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীর ওপর পরিদর্শন করে। ২০২০ সালে দীর্ঘ পরিদর্শন শেষে ২০২১ সালে এসে দিকনির্দেশনা দেয়। পরে বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান রহমান রহমান হকের বিশেষ নিরীক্ষায়ও অনিয়মের সত্যতা পাওয়া যায়। একসময় দেশের অন্যতম সেরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল উত্তরা ফাইন্যান্স। তবে জালিয়াতির তথ্য ফাঁসের পর প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত চিত্র সামনে আসে।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে, কলমানি থেকে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ঋণের ৩৮২ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে না দেখিয়ে তৎকালীন পরিচালক ও মতিউর রহমানের ভাই মুজিবুর রহমান নিজের কাজে ব্যবহার করেন। এক টাকাও না রেখেও মুজিবুরের মালিকানাধীন ব্লু চিপস সিকিউরিটিজের নামে ২৩৬ কোটি টাকার ভুয়া মেয়াদি আমানত দেখানো হয়। পরিচালকদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান অগ্রিম ও প্রি-পেমেন্ট খাতের নামে বের করে ৮৮৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ‘অ্যাডভান্স অ্যান্ড পেমেন্ট’ নামে চেয়ারম্যান রাশেদুল হাসানসহ কয়েকজনকে প্রাপ্যতাবহির্ভূতভাবে ৭৯৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়। মার্জিন ঋণ ও মার্চেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের ঋণের নামে ৫৯৭ কোটি এবং মার্জিন ঋণের নামে ৫২১ কোটি টাকা পরিচালকদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ছাড় হয়। তখনকার এমডি শামসুল আরেফিন নিজে হিসাববহির্ভূত বিভিন্ন উপায়ে ২৪ কোটি ২২ লাখ টাকা তুলে নিয়ে গাড়ি, বাড়ি কেনা ও বিদেশ ভ্রমণে ব্যয় করেন। এর বাইরে অনুমোদন ছাড়া ভবন ভাড়া এবং ‘ইনভেস্টর অ্যাকাউন্টস’ নামে গোপন হিসাবের মাধ্যমে ৬৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জালিয়াতি হয়। সব মিলিয়ে নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সময়ে পরিচালক ও এমডির সম্পৃক্ততায় অন্তত ৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় অনিয়ম পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

Share this news