তদন্তের পরও শেয়ার কারসাজি চলছে!

Date: 2023-02-15 16:00:20
তদন্তের পরও শেয়ার কারসাজি চলছে!
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জেমিনি সি ফুডের শেয়ার প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ৪৫০ টাকা বা ৩১১ শতাংশ বা সাড়ে ৩ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পরে তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কাছে দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও কোম্পানিটির শেয়ারে থেমে নেই কারসাজি। প্রথম দফায় দুই বছরে সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধির পর শেয়ারটির দাম কমতে শুরু করে। এতে প্রায় সাড়ে ৪২ শতাংশ কমার পর শেয়ারদর পুনরায় কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো চলছে। ফলে তদন্ত ও শাস্তির কোনো তোয়াক্কা না করেই কারসাজি চলছে বলে জানিয়েছে বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তাই একবার শুধু নজর দিয়েই শেষ না করে, প্রতিনিয়ত নজরদারির এবং কারসাজি বন্ধে কঠিন শাস্তির দাবি জানান তারা।কোম্পানিটির শেয়ারদর ও লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ১৯ অক্টোবর কোম্পানির শেয়ারদর প্রথম দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে আসে। কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসের ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সায় বেশ কয়েকদিন অবস্থান করে। এরপর কারসাজি চক্র ৯ জুন শেয়ারদর বাড়িয়ে ১৫৪ টাকা ৮০ পয়সায় নেয়। এরপর উত্থান পতনের মাধ্যমে শেয়ারটির দর প্রথমে গত বছরের এপ্রিলে সর্বোচ্চ ৫২৮ টাকার ওপরে উঠানো হয়। কারসাজি চক্র প্রথম দফায় শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে গেলে শেয়ারদর কমতে থাকে। পরে আবার কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারটির দর ধীরে ধীরে কমানো-বাড়ানোর মাধ্যমে ১৯ অক্টোবর দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়। এদিন লেনদেন শেষে শেয়ারটির দর দাঁড়ায় ৫৯৩ টাকা ৪০ পয়সায়। তবে কোম্পানিটি বছর শেষে লভ্যাংশ ঘোষণা করলে এর পর থেকে শেয়ারের দর আবার কমতে থাকে। এতে শেয়ারদর কমে ৩৪১ টাকা ৭০ পয়সা হয়, যা কারসাজিকারীদের বের হয়ে যাওয়ার চিত্র বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ফলে দ্বিতীয় দফায় কারসাজি শেষে শেয়ারদর ২৫১ টাকা ৭০ পয়সা বা ৪২ দশমিক ৪১ শতাংশ কমে। এরপর আবার কারসাজি শুরু হয় শেয়ারে। দেখা যায়, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি শেয়ারটির দর বাড়িয়ে ৫০২ টাকা ৯০ পয়সায় নেয়া হয়েছে।লেনদেন চিত্রে দেখা গেছে, কারসাজি শেষ হলেই কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেনে পতন ঘটে। সেক্ষেত্রে কারসাজি চলার সময় কোম্পানির শেয়ার লেনদেন এক দিনে ৩ লাখ ৬৫ হাজার থেকে শুরু করে ৬ লাখ ২৭ হাজার পর্যন্ত ওঠে। এরপর কারসাজি শেষে আবার লেনদেন কমে যায়। সে সময় লেনদেন এক দিনে কমে ১ লাখ থেকে ৫০ হাজারের নিচেও নামে। পরে আবার কারসাজির মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন বৃদ্ধি করে ২ লাখ ৬৫ হাজার থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ লাখ ৬৯ হাজার পর্যন্ত নেয়া হয়।এদিকে কোম্পানিটির শেয়ারদর ও লেনদেনে কারসাজির চেষ্টা, ইনসাইডার ট্রেডিং এবং অন্যান্য কার্যকলাপ তদন্তে গত বছরের ২৫ অক্টোবর দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে বিএসইসি। কমিটিকে আদেশ জারির আগামী ২০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেনÑবিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ রকিবুর রহমান ও সহকারী পরিচালক ফয়সাল ইসলাম। সেই তদন্ত শেষে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে কমিটি এবং বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নিতে বর্তমানে বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগে কার্যক্রম চলমান বলে জানা যায়।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, জেমিনি সি ফুডের শেয়ারে কারসাজি তদন্তে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল তারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। বিষয়টি বর্তমানে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কাছে রয়েছে। যে সময় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, সে সময়ের শেয়ার ও লেনদেনকে কেন্দ্র করে তা করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে শেয়ারটির দর ও লেনদেনের বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। তবে শেয়াটির দর ও লেনদেনে যদি অস্বাভাবিক চিত্র দেখা যায়, তবে আবার নজরদারির আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।অপরদিকে সে সময় বিএসইসির আদেশে বলা হয়েছে, বিএসইসি জেমিনি সি ফুডের শেয়ারের লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছু অস্বাভাবিক মূল্য ও ভলিউম গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছে। কমিশন মনে করে এ বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তদন্ত করা প্রয়োজন। তদন্তে কোম্পানিটির সাম্প্রতিক অনিরীক্ষিত এবং নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা, বাজার কারসাজির প্রচেষ্টা চিহ্নিত করা, ইনসাইডার ট্রেডিং শনাক্ত করা এবং অন্যান্য অসদাচরণ বা প্রতারণামূলক কার্যকলাপ হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানানো হয়েছে।তাই সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ (১৯৬৯ সালের অর্ডিন্যান্স নং ঢঠওও) এর সেকশন ২১ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ (১৯৯৩ সালের ১৫নং আইন) এর ১৭ক ধারা এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ) ১৯৯৫ এর বিধি ৬ অনুযায়ী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেয়া হলো বলে জানানো হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা এ আদেশ জারির ২০ কার্যদিবসের মধ্যে বিএসইসতে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে বলে জানিয়েছে কমিশন।প্রসঙ্গত, জেমিনি সি ফুডের সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে কোম্পানিটি ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি ৫ টাকা ৩১ পয়সা আয় করলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে ৩ টাকা ১ পয়সা হয়েছে। ঠিক একই ভাবে এনএভি প্রথম প্রান্তিকে ১৮ টাকা ৪১ পয়সা কমে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১৭ টাকা ১৮ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া কোম্পানিটির এনএভি ২০২১-২০২২ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ৫ টাকা ৭৬ পয়সা হলেও ১৮ অক্টোবর শেয়ারের মূল্য ৫৬১ টাকা হয়। সেই সঙ্গে কোম্পানির চলতি ২০২১-২০২২ হিসাব বছরের আয়ে এক ভুতুড়ে হিসাব দেখা যায়। কোম্পানি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ার প্রতি ৫ টাকার বেশি আয় করলেও তৃতীয় প্রান্তিকে আয় করেছে মাত্র ৪ পয়সা। এদিকে ৯ মাসের ব্যবধানে এনএভি বেড়েছে ৫১৯ শতাংশের বেশি। এরপর আবার বছর শেষে কোম্পানির ইপিএস দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ৪৯ পয়সায় এবং এনএভি হয়েছে ১৩ টাকা ১০ পয়সা। এতে ৯ মাসের বিপরীতে মাত্র তিন মাসে ইপিএস বেড়েছে ৭ টাকা ৩৩ পয়সা বা ১৪২ শতাংশ এবং এনএভি বেড়েছে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা বা ১২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অপরদিকে কোম্পানিটির বিগত আর্থিক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৯ টাকা ৮৩ পয়সা। এর আগের ২০১৮ ও ২০১৯ হিসাব বছরে যথাক্রমে ইপিএস হয়েছে মাত্র ৭০ ও ৩৭ পয়সা। আর ২০২০ সালে এনএভি ছিল মাত্র ২১ পয়সা।তাই কোম্পানিটির আয়ে এবং আর্থিক প্রতিবেদনে এমন গড়মিলের হিসাবকে কারসাজি বলছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। এ ধরনের হিসাব কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির কারণে প্রকাশ করা হয়েছে এবং কারসাজিতে কোম্পানির যোগসাজশ রয়েছে বলে দাবি করেন তারা। সেই সঙ্গে এর পেছনে কোম্পানির কোনো কারসাজি রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখার দাবি জানানো হয়।

Share this news