সমুদ্রপথের নেতৃত্বে আবার কবে ফিরে আসবে বিএসসি

Date: 2023-02-25 20:00:17
সমুদ্রপথের নেতৃত্বে আবার কবে ফিরে আসবে বিএসসি
পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ছোট, আমদানি-রপ্তানিও ছিল সীমিত। ৫০ বছরে দেশ এগিয়েছে, বাণিজ্যও বেড়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। প্রতিষ্ঠানটির জাহাজের বহর ও ব্যবসা বড় হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন ছোট হয়েছে। ১৯৭৪ সালে তাদের ১৪টি জাহাজ ছিল, এখন কমে হয়েছে ৮টি। ওই সময় বেসরকারি মালিকানাধীন কোনো সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল না। এখন চিত্র উল্টো, বেশির ভাগ জাহাজের মালিক বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী।খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএসসির পিছিয়ে পড়ার কারণ মূলত অব্যবস্থাপনা ও অদূরদর্শিতা। সময় ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি। তাই প্রায় বছরই লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে গত অর্থবছরে তারা প্রায় ২২৫ কোটি টাকা লাভ করেছে।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৭৪ সালে দেশের জাতীয় বাজেট ছিল মাত্র ৯৯৫ কোটি। আর এখন বছরে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এই আমদানির ৯০ শতাংশই আসে জলপথে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানি সহজ, সাশ্রয়ী ও জনপ্রিয়। দেশের প্রায় ৭২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র জলসীমা আছে, এর সঙ্গে সংযোগ ভারত মহাসাগরের। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বিএসসি। ফলে জাহাজে পণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সিংহভাগই চলে গেছে বেসরকারি খাতে। বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী এই খাতে বিনিয়োগ করেছে, জাহাজের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়েছে।তবে বিএসসির কর্মকর্তারা দাবি করেন, বর্তমান সরকার সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে বিএসসির সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। এতে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বৈচিত্র্যময় জাহাজ দিয়ে বিএসসির বহর বড় করার চেষ্টা চলছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি করা গেলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়ানো সম্ভব।বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মো. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, বহরে কনটেইনার জাহাজ, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বহনকারী জাহাজ ও অপরিশোধিত তেল পরিবহনের জাহাজ যুক্ত করার পরিকল্পনা আছে। নিজস্ব অর্থায়নের বদলে বিদেশি অর্থায়নের চেষ্টা চলছে। এসব যুক্ত করতে পারলে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে, আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।বাংলার দূত থেকে বাংলার অগ্রদূত১৯৭২ সালে যাত্রা শুরুর সময় বিএসসির নিজস্ব কোনো জাহাজ ছিল না। প্রতিষ্ঠার চার মাস পর প্রথম জাহাজ যুক্ত হয়। ‘বাংলার দূত’ নামের ওই জাহাজটি ছিল কার্গো জাহাজ। তখন থেকে পণ্য পরিবহনের ব্যবসায় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় বিএসসির। এরপরেই যুক্ত হয় ‘বাংলার সম্পদ’ নামে আরেকটি জাহাজ।এভাবে ১৯৭৪ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠানটির বহরে ১৪টি জাহাজ যুক্ত হয়। এরপর ১৯৮২ সালে ২৭টি এবং পরের আট বছরে বিএসসির বহরে মোট জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮। তবে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় ২৫টি জাহাজ পরিত্যক্ত হয়। ফলে ২০০৮ সাল নাগাদ বিএসসির মালিকাধীন জাহাজ ১৩টিতে নেমে আসে। কিন্তু এই ১৩টি জাহাজও লক্কড়ঝক্কড় হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে তেমন লাভ হয়নি। পরে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তিনটি করে মোট ছয়টি জাহাজ কেনা হয়। এগুলো চীনের তৈরি, তৈরির সাল ২০১৮।বিএসসির তালিকা অনুযায়ী, সর্বশেষ সংগ্রহ করা জাহাজটি হচ্ছে এমটি ‘বাংলার অগ্রগতি’। এই ছয়টি জাহাজের তিনটি ‘অয়েল কেমিক্যাল ট্যাংকার’ ও বাকি তিনটি ‘বাল্ক ক্যারিয়ার’।বিএসসির তথ্য অনুযায়ী, এখন বহরে থাকা আটটি জাহাজের মধ্যে এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার সমৃদ্ধি ও এমভি বাংলার অর্জন জাহাজ তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার। আর এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা, এমটি বাংলার অগ্রদূত ও এমটি বাংলার অগ্রগতি জাহাজ তিনটি অয়েল কেমিক্যাল ট্যাংকার। বাকি পুরোনো দুই জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভের বয়স প্রায় ৩৬ বছর। ১৯৮৭ সালে তৈরি জাহাজ দুটি ডেনমার্কের তৈরি। এই দুটি ‘লাইটারেজ জাহাজ’ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।বিএসসির কর্মকর্তারা বলছেন, একটি জাহাজের আয়ুষ্কাল সাধারণত ২৫ বছর। এরপর সেটি পরিচালনা করা তেমন লাভজনক হয় না। কারণ, নিয়মিত মেরামতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পুরোনো জাহাজ চালানোর জন্য জরিমানা গুনতে হয়।বিএসসি বলছে, বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি চাহিদা ‘কনটেইনার ভেসেলের’। এই জাহাজের ব্যবসাও দিন দিন বড় হচ্ছে। বাংলাদেশেও চাহিদা ব্যাপক। কিন্তু বিএসসিতে এ ধরনের জাহাজ নেই।রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছর ইউক্রেনের একটি বন্দরে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ নামে একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাহাজটি এখনো সেখানেই আটকে আছে। ফলে এখন মূলত বিএসসির কাছে সাতটি জাহাজ আছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমুদ্রপথে জাহাজ পরিচালনাকারী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটি কবে ফিরবে, কেউ জানে না।বিএসসির মূল সমস্যা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা পর্ষদ তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারা ব্যবসাও করতে পারে না।২৭ বছরের অবহেলাবেসরকারির কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা শুরু করলে দিন দিন বড় করার পরিকল্পনা থাকে। প্রয়োজন অনুযায়ী অবকাঠামো ও যানবাহনে পরিবর্তন আনে। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে অবহেলা–উদাসীনতায় জৌলুশ হারাতে থাকে বিএসসি। তখন থেকে ২৭ বছর বিএসসির বহরে নতুন কোনো জাহাজ যুক্ত হয়নি। আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় একের পর এক স্ক্র্যাপ করা হয় বিএসসির জাহাজ। এতে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বিএসসি।বিএসসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আশির দশকে দেশে সমুদ্রগামী জাহাজের সিংহভাগেরই মালিক ছিল বিএসসি। কিন্তু সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। সড়কপথের ব্যবসার মতো সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের ব্যবসাও বেসরকারি খাতে চলে গেছে।দেশে সমুদ্রগামী জাহাজসহ নৌযানের নিবন্ধন দেয় নৌপরিবহন অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সাল থেকে টানা ছয় বছর একচেটিয়া ব্যবসা করেছে বিএসসি। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে বেসরকারি খাত যুক্ত হয়। অ্যাটলাস শিপিং লাইনস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সানাউল্লাহ চৌধুরী ওই বছর ১০ হাজার টন পণ্য পরিবহনক্ষমতার ‘এমভি আল–সালমা’ নামে একটি জাহাজের নিবন্ধন নেন। এরপর পর্যায়ক্রমে কেএসআরএম, এমজিআই, আকিজ গ্রুপ, কর্ণফুলী লিমিটেড, বসুন্ধরা গ্রুপসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জাহাজ ব্যবসা শুরু করেন।নৌপরিবহন অধিদপ্তর বলছে, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত সমুদ্রগামী জাহাজ আছে ৯০টি। এর মধ্যে ৮২টিই বেসরকারি খাতে পরিচালিত হচ্ছে।জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজের বহর পরিচালনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত যথাযথ পরিকল্পনা ও আধুনিক জাহাজ যুক্ত করে উন্নতির দিকে যেতে হয়। কিন্তু সেভাবে কোনো ব্যবস্থা না নিতে পারায় বিএসসির বহর ছোট হয়ে গেছে। তবে ২০১৪ সাল থেকে বিএসসি উন্নতি করছে।লাভে ফিরেছে বিএসসিএক যুগ আগেও লোকসানি প্রতিষ্ঠান ছিল বিএসসি। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে। ওই সময় লোকসান হয় ১০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। লোকসানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দার কারণে আন্তর্জাতিক শিপিং ব্যবসায় ধস নামে, জাহাজে পণ্য পরিবহনের ভাড়া কমে যায়।অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় পুরোনো জাহাজের মেরামত ও পরিচালনা ব্যয়ের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে গিয়ে লোকসান গুনতে হয়। এরপর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত আর লোকসান হয়নি বিএসসির।প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে সর্বশেষ অর্থবছরে। নতুন জাহাজ যুক্ত হওয়ার পরও করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের কারণে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে লাভ প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লাভ ছিল ৪১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে লাভ বেড়ে হয়েছিল ৭২ কোটি ২ লাখ টাকা। গত অর্থবছরেই প্রতিষ্ঠানটির লাভ ২০০ কোটি টাকা ছাড়ায়। গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম লাভ হয়েছিল ২০১২-১৩ অর্থবছরে। ওই বছর মোট লাভ ছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

Share this news