সিঙ্গাপুরে বাড়ছে আজিজ খানের সম্পদ, দেশে উল্টোরথে সামিট

Date: 2022-11-15 16:00:20
সিঙ্গাপুরে বাড়ছে আজিজ খানের সম্পদ, দেশে উল্টোরথে সামিট
সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ২০১৮ সালেই নাম লিখিয়েছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। কয়েক বছর ধরেই সে দেশে তার সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে। যদিও দেশে অনেকটা উল্টো পথেই হাঁটছে সামিট পাওয়ার। কোম্পানিটির মুনাফায় নেমেছে ধস, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এক বছরেই মুনাফা কমেছে ২০ শতাংশ। পাশাপাশি দায়দেনা অনেক বেড়ে গেছে সামিটের। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে কোম্পানিটির ডেট-ইকুইটি অনুপাত।এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ খাতের বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যেও মুনাফার দিক দিয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সামিট পাওয়ার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ইপিএস (শেয়ারপ্রতি আয়) তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম ছিল কোম্পানিটির। যদিও চার বছর ধরেই সামিট পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা একই (১৫টি) রয়েছে। এর আগে ছিল ১৪টি। কোম্পানিটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।সূত্রমতে, সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় এ বছর টানা পঞ্চমবারের মতো নাম ওঠে মুহাম্মদ আজিজ খানের। বিজনেস সাময়িকী ফোর্বসের গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত তালিকায় তিনি ছিলেন ৪২ নম্বরে। তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১০৫ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় তার সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১ সালে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ডলার, ২০২০ সালে ৯৫ কোটি ডলার ও ২০১৯ সালে ৮৫ কোটি ডলার।ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা মুহাম্মদ আজিজ খান দেশটির শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় প্রথম স্থান পান ২০১৮ সালে। ওই বছর সিঙ্গাপুরে তার ও তার পরিবারের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি মার্কিন ডলার। তবে ২০১৯ সালে মুহাম্মদ আজিজ খান জাপানি প্রতিষ্ঠান জেরার কাছে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ার ৩৩ কোটি ডলারে বিক্রি করে দেন। ফলে ২০১৯ সালে তার সম্পদের পরিমাণ কমে যায়। তবে এর পর থেকে আবার তার সম্পদের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে।এদিকে সামিট পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়া হিসাববছরে সামিট পাওয়ারের আয় তথা টার্নওভার দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৩১৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর আগের বছরে (২০২০-২১) এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৯৬৬ কোটি ছয় লাখ টাকা। অর্থাৎ গত হিসাববছরে কোম্পানিটির আয় বেড়েছে এক হাজার ৩৫২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বা ৩৪ দশমিক ১০ শতাংশ। যদিও আয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়েনি কোম্পানির মুনাফায়। বরং গত হিসাববছরে সামিট পাওয়ারের মুনাফা কমেছে ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ।২০২০-২১ হিসাববছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফার পরিমাণ ছিল ৮৪২ কোটি ৯২ লাখ টাকা, গত অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় ৬৭৩ কোটি টাকায়। এ হিসাবে এক বছরে সামিট পাওয়ারের মুনাফা কমেছে ১৬৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর কোম্পানিটির মুনাফার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮৪৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং ৭২৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ চার বছরের সবচেয়ে কম মুনাফা হয়েছে সামিটের। এর আগে ২০১৭-১৮ হিসাববছরে সামিট পাওয়ারের মুনাফার পরিমাণ ছিল ৫২৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা।তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিট মুনাফার পাশাপাশি সামিট পাওয়ারের মুনাফা মার্জিনেও ধস নেমেছে। ২০১৭-১৮ হিসাববছরে কোম্পানিটির মুনাফা মার্জিন ছিল ২৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ২০১৮-১৯ হিসাববছরে ২৩ দশমিক ৯০ শতাংশ, ২০১৯-২০ হিসাববছরে ৩৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, ২০২০-২১ হিসাববছরে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ২০২১-২২ হিসাববছরে ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত হিসাববছরে সবচেয়ে কম মুনাফা মার্জিন ছিল সামিট পাওয়ারের।এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে লিখিত প্রশ্ন পাঠানোর কথা বলেন সামিট গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মোহসেনা হাসান। পরে তিনি শেয়ার বিজকে জানান, কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনেই এ বিষয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে। উল্লেখিত ব্যাখ্যাই তাদের বক্তব্য, যা ইংরেজিতে প্রণীত।বার্ষিক প্রতিবেদনে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা নাজুক হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় ডলার কিনতে অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বিল না দিলেও সামিট পাওয়ার তার চারটি সহযোগী কোম্পানির আগের খোলা এলসির দায় সমন্বয় করেছে। সিঙ্গাপুরে অবস্থিত সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানির (এসওএসসিএল) কাছ থেকে ফার্নেস অয়েল (এইচএফও) আমদানিতে এলসি খোলা অব্যাহত রাখতে তা করা হয়।কোম্পানিটি আরও জানায়, সামিট পাওয়ারের সহযোগী কোম্পানিগুলোর অধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে যেন কোনো সমস্যা না হয়, তা নিয়ে সামিট পাওয়ারের পর্ষদে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা অনুযায়ী কোম্পানিটির পর্ষদ একটি এজেন্ডা অনুমোদন করে এবং বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) শেয়ারহোল্ডারদের অনুমদোনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। উপস্থাপনকৃত এজেন্ডায় বলা হয়, সহযোগী কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সচল রাখতে ফার্নেস অয়েল আমদানি চালু রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে আগের এলসির দায় সমন্বয় ও নতুন এলসি খুলতে এবং সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানির বিল পরিশোধ করতে হবে। তাই বিপিডিবির বিল পরিশোধে দেরি হওয়া এবং মুদ্রার বিনিময় হারের দ্রুত পরিবর্তনের কারণে সামিট করপোরেশন এবং সামিট পাওয়ারের দুই উদ্যোক্তার পক্ষ থেকে টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।তথ্যমতে, দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলো গত হিসাববছরে বেশ ভালো মুনাফা করেছে। সামিট পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদনেই বিষয়টি উঠে আসে। এক্ষেত্রে ইপিএসের দিক দিয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সামিট পাওয়ার। বিদায়ী হিসাববছরে কোম্পানিটির ইপিএস কমে দাঁড়ায় তিন টাকা ৮৭ পয়সা, যা আগের হিসাববছরে ছিল পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা। অর্থাৎ ২০২১-২২ হিসাববছরে সামিটের ইপিএস কমেছে এক টাকা ৩৮ পয়সা বা ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।গত হিসাববছরে সবচেয়ে বেশি ইপিএস ছিল ইউনাইটেড পাওয়ারের। এ সময় কোম্পানিটির ইপিএস দাঁড়ায় ১৭ টাকা ২১ পয়সা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা শাহজীবাজারের ইপিএস ছিল ১১ টাকা ৯১ পয়সা, তৃতীয় অবস্থানে থাকা ডরিন পাওয়ারের ইপিএস ১০ টাকা ৯৯ পয়সা এবং চতুর্থ অবস্থানে থাকা বারাকা পাওয়ারের ইপিএস ছিল সাত টাকা ৪০ পয়সা। এর আগের হিসাববছরে এ চার কোম্পানির ইপিএস ছিল যথাক্রমে ১৮ টাকা ৮০ পয়সা, ছয় টাকা ৫৩ পয়সা, আট টাকা ৯ পয়সা ও সাত টাকা ৪০ পয়সা।এদিকে সামিট পাওয়ারের ডেট-ইকুইটি অনুপাত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। গত হিসাববছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা নির্দেশ করে। এ সময়ে কোম্পানিটির দায়দেনা বেড়েছে প্রায় দুই হাজার ৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর আগের চার বছরে সামিট পাওয়ারের ডেট-ইকুইটি অনুপাত বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। এর মধ্যে ২০২০-২১ হিসাববছরে এ অনুপাত ছিল ৬৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ, ২০১৯-২০ হিসাববছরে ৬৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ, ২০১৮-১৯ হিসাববছরে ৬৭ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ হিসাববছরে ৭৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।অন্যদিকে সামিট পাওয়ারের রিটার্ন অব ইকুইটি অনুপাতও পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। এ অনুপাত ২০২১-২২ হিসাববছরে দাঁড়ায় ১১ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ, ২০২০-২১ হিসাববছরে ১৫ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০১৯-২০ হিসাববছরে ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ, ২০১৮-১৯ হিসাববছরে ১৫ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ হিসাববছরে ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। একই অবস্থা কোম্পানিটির রিটার্ন অব অ্যাসেটের। পাঁচ বছরের ওই অনুপাতও সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।শুধু তাই নয়, আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দেয়ার হারও কমিয়েছে সামিট পাওয়ার। গত হিসাববছরে কোম্পানিটি ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর আগে ২০২০-২১, ২০১৯-২০ ও ২০১৮-১৯ হিসাববছরে দিয়েছিল ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ। আর ২০১৭-১৮ হিসাববছরে দিয়েছিল ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ।

Share this news