সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না বিএসইসি!

Date: 2022-12-21 16:00:13
সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না বিএসইসি!
দেশের উভয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে গতকাল বুধবার ১৬৯টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর আগে গত জুলাইয়ে পুঁজিবাজারের বড় পতন ঠেকাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস জারি করে কমিশন। ফ্লোর প্রাইস দেয়ার কয়েকদিন পর থেকে তুলে দেয়ার বিষয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন ও আলোচনা শুরু হয়। এর মধ্যে রয়েছে শেয়ারদর ন্যায্যমূল্য থেকে বেশি থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ কমে যাওয়া, বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণের চাপ এবং কিছু মহল থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার দাবি। তাই ইচ্ছে বা উচিত না হলেও পুঁজিবাজারের স্বার্থে বাধ্য হয়ে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়েছে বলে জানায় বিএসইসি। কিন্ত সাম্প্রতিক সময়ে আপাতত বা স্বল্প সময়ের মধ্যে ফ্লোর প্রাইস উঠছে না বলে জানিয়েছিল কমিশন। কিন্তু শেষমেশ সে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না বিএসইসি। অবশেষে প্রথম ধাপে ১৬৯টি কোম্পানির শেয়ারদর সর্বোচ্চ ১ শতাংশ কমার নিয়ম রেখে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা।বিএসইসির জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া ১৬৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ডও রয়েছে। ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম এক দিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না। তবে নিয়ম অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের দাম এক দিনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারবে।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়েছে সম্মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন বাজারের মোট মূলধনের প্রায় ৫ শতাংশ। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমলেও তার বড় ধরনের কোনো প্রভাব সূচকে পড়বে না। বাজারে যাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেজন্য কম মূলধনি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকেই মূলত ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়।ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে সাধারণ বীমা খাতের ৩১টি, জীবন বীমা খাতের ৬টি, ৩৬টি মিউচুয়াল ফান্ড খাতের, বস্ত্র খাতের ২৬টি, প্রকৌশল খাতের ১৬টি, ১০টি খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের, আর্থিক খাতের ১০টি, বিবিধ খাতের ৯টি, ৫টি ওষুধ ও রসায়ন খাতের, ৪টি তথ্য প্রযুক্তি খাতের, পাট খাতের ৩টি, ৩টি চামড়া খাতের, ৩টি কাগজ ও মুদ্রণ খাতের, সিমেন্ট খাতের ২টি, বিদ্যুৎ খাতের ২টি এবং সেবা ও আবাসন খাতের বাংলাদেশ সার্ভিসেস, ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের শমরিতা হসপিটাল এবং সিরামিক খাতের স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস।এর আগে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ দরপতন দেখা দিলে গত ২৮ জুলাই প্রতিটি সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস বেধে দেয় বিএসইসি। এতে বাজারে দরপতন কিছুটা কমলেও লেনদেন খরা দেখা দেয়। এছাড়া সার্কিট ব্রেকারের বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০০ টাকার নিচে থাকা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বা ইউনিটের দাম এক দিনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়তে পারে। একইভাবে ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে থাকা প্রতিষ্ঠানের ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে থাকলে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ, ১০০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে থাকলে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, ২০০০ থেকে ৫০০০ হাজার টাকার মধ্যে থাকলে ৫ শতাংশ এবং ৫০০০ টাকার ওপরে হলে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে।অপরদিকে সম্প্রতি লেনদেন খরা আরও প্রকট হয়েছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে টানা দরপতন। শেষ ছয় কার্যদিবস পুঁজিবাজারে টানা দরপতন হয়েছে। লেনদেন হয়েছে তিনশ থেকে চারশ কোটি টাকার ঘরে। এতে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসে। তাতে এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেন একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারে। এ কারণে লেনদেনও কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার সুপারিশ করে। তার ভিত্তিতে গতকাল প্রথম ধাপে ১৬৯ প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।কিন্তু গত ৫ ডিসেম্বর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে দরপতন ঠেকাতে তালিকাভুক্ত সব শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়েছে। তবে এটি সাময়িক, কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয় বলে মন্তব্য করে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, এখনই ফ্লোর প্রাইস উঠছে না। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে মার্জিন ঋণে যারা শেয়ার কিনেছেন, ফোর্স সেলের কারণে তারা নিঃস্ব হয়ে যাবেন। এছাড়া তিনি আরও একাধিক অনুষ্ঠান ও সাক্ষাৎকারে এখনই ফ্লোর প্রাইস তুলে না নেয়ার বিষয়টি বলেলও সেটা আর স্থায়ী হলো না।এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে এক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিজকে বলেন, বাজারে দীর্ঘ সময় ধরে কারসাজি করে বেশিরভাগ শেয়ার ন্যায্যমূল্য থেকেও অনেক বৃদ্ধি করা হয়। পরে যখন শেয়ারগুলোর দর কারেকশন হয়ে কমতে থাকে, তখনই বড় পতন হয়। সেই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতেই কমিশন ফ্লোর প্রাইস দেয়। বাজারে শুধু হিরো-সহযোগী ছাড়া আরও কারসাজিকারী রয়েছে। তারা সবাই এ কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাজার ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। তাই কমিশনের উচিত শুধু ফ্লোর প্রাইস না দিয়ে সেসব কারসাজিকারীকে এমন শাস্তি দেয়া যাতে আর কারসাজি করতে না পারে। আর যতদিন শেয়ারের দাম ন্যায্য অবস্থানে না আসবে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সেই ভাবে বিনিয়োগ করবে না। তাই ধীরে ধীরে কমিশনকে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতেই হতো। তবে সেটা যেন কারসাজি করার সুযোগ না হয় সে বিষয়ে বিএসইসির সঠিক নজরদারি দাবি তুলেন তিনি।এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক শেয়ার বিজকে বলেন, বিএসইসি পুঁজিবাজারের জন্য অনেক সিদ্ধান্ত নিলেও কিছু বিষয় ভালো করে। তবে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত বাজারের জন্য ভালো কিছু করতে পারে না। সেই সঙ্গে কমিশনের এমন হুট-হাট সিদ্ধান্ত বাজার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতিকর। যে কারণে বিএসইসি কোনো কিছু বললে সেটা দীর্ঘ সময়ে ঠিক থাকে না। এছাড়া ওপর মহলের কারণে বিএসইসির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়াটা ঠিক হয়নি। এতে কারসাজিকারীরা সুযোগ পাবে এবং বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ফ্লোর প্রাইসে থাকা যেসব ভালো কোম্পানি আটকে ছিল, যারা ভালো লভ্যাংশ দেয়ার পরও দর বৃদ্ধি হচ্ছিল না এবং সেসব শেয়ারে বিনিয়োগ না হওয়ার পেছনে নজর দিলে ভালো হতো। এতে যারা বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিয়ে শেয়ারের দাম কমার জন্য বসে আছে তাদের বিনিয়োগে নিয়ে এলে এবং বাজার ভালো হলে ধীরে ধীরে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশি ভালো হতো।

Share this news