শেয়ারবাজারে সূচকের বড় পতন ঠেকানো হলো নানা উদ্যোগ নিয়ে

Date: 2024-01-21 16:00:09
শেয়ারবাজারে সূচকের বড় পতন ঠেকানো হলো নানা উদ্যোগ নিয়ে
দেড় বছর পর বড় ধরনের দরপতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। এক দিনে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৯৬ পয়েন্ট। যদিও লেনদেন শুরুর প্রথম ৫ মিনিটে সূচকটি ২১৫ পয়েন্ট কমে যায়। পরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যুক্ত হয়ে এই সূচকের বড় পতন থামান।শেয়ারবাজারে দামের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস উঠে যাওয়ার প্রথম দিন গতকাল রোববার সূচকের বড় ধরনের উত্থান-পতন ঘটে। দিন শেষে ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৪০ পয়েন্টে। লেনদেন হওয়া ৩৮৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯৬টিরই দরপতন হয়েছে, দাম বেড়েছে ৫৪টির। আর অপরিবর্তিত ছিল ৩৬টির দাম। যদিও দিনের শুরুতে মাত্র ৩টির দাম বেড়েছিল, কমেছিল ৩০০-এর বেশি শেয়ারের দাম। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের কোনো লেনদেন হয়নি দীর্ঘদিন। তাই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ায় দিনের শুরুতে বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ শেয়ার বিক্রি শুরু করে। কারণ, দীর্ঘদিন আটকে থাকা তাঁদের পুঁজি ফিরে পেতে তৎপর ছিলেন। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়েছিল। ফ্লোর প্রাইস ছিল এমন একটা ব্যবস্থা, যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দিয়েছিল। এর ফলে কোনো শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের বেঁধে দেওয়া দামের নিচে মানার সুযোগ ছিল না। গত বৃহস্পতিবার ৩৫টি কোম্পানি বাদে বাকি সব প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেওয়া সেই দামের সীমা তুলে নেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসি।ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার কারণে বাজারে যাতে বিনিয়োগকারীরা ‘আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি’ না করেন, সে জন্য সকাল থেকে ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির তৎপরতা।জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কেউ যাতে বাজারে বড় ধরনের কোনো অনিয়ম করতে না পারে, সে জন্য সব ধরনের তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে। অনেকে মনে করেছিলেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে বাজারে অপ্রত্যাশিত দরপতন হবে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে সেটি হয়নি। যেটুকু পতন হয়েছে, সেটাকে বিএসইসি অপ্রত্যাশিত মনে করছে না। তাদের পর্যালোচনা অনুযায়ী, দু-এক দিনের মধ্যে বাজার তার নিজস্ব গতি ফিরে পাবে।সিইও ফোরামের বৈঠকবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকালে লেনদেন শুরুর আগে শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন সিইও ফোরাম অনলাইনে বৈঠক করে। বৈঠকে ২৮ জন সিইও কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেন। তার মধ্যে ছিল পতন ঠেকাতে বাজারে প্রত্যেকে নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী বিনিয়োগ বাড়াবেন, যেসব শেয়ারের ক্রেতা থাকবে না, সেগুলোর বিক্রয়াদেশ দেওয়া বন্ধ রাখবেন। পাশাপাশি এ-ও সিদ্ধান্ত হয়, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি না করেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব কারণে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দিনের শুরুতে সূচক যতটা কমেছিল, দিন শেষে তার একটি বড় অংশ পুনরুদ্ধার হয়।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী প্রথম আলোকে বলেন, বাজার তার নিজস্ব গতি ফিরে পেতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। এ সময়ে যদি বড় ধরনের কোনো পতন না হয়, তাহলে বাজার তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে।ভালো শেয়ারে আগ্রহ বেশিডিএসইর সার্বিক সূচকটি গতকাল ৯৬ পয়েন্ট কমলেও বাছাই করা ভালো মানের ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচকটি বেড়েছে। সূচকটি এ দিন সাড়ে ৭ পয়েন্ট বাড়ে। ঢাকার বাজারের সার্বিক সূচকে গতকাল যে কয়েকটি কোম্পানি ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল ডিএস-৩০ সূচকভুক্ত কোম্পানি স্কয়ার ফার্মা, লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট, কোহিনূর কেমিক্যালস, ব্র্যাক ব্যাংক, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন বা বিএসসি।বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ফ্লোর প্রাইস উঠে যাওয়ায় লেনদেনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারের বিনিয়োগে আগ্রহী হয়েছেন।কেনা বেশি, বিক্রি কমগতকাল শেয়ারবাজারে লেনদেনের শীর্ষে থাকা পাঁচটি ব্রোকারেজ হাউসের কেনাবেচার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা শেয়ার কিনেছে বেশি, বিক্রি করেছে কম।জানতে চাইলে ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ছায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজার যাতে তার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসে, সে জন্য আমরা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও সক্রিয় ছিলাম। বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের বাইরে গতকাল আমরা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছি।’ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামল দামগত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডিএসইতে ২১৮টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল। এর মধ্যে গতকাল ১৭৯টির দাম কমে যায়। মূলত এসব কোম্পানির কারণে সূচকে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সূচক গণনার পদ্ধতি অনুযায়ী, গতকাল ১০টি কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের কারণে ডিএসইএক্স সূচকটি ৬২ পয়েন্টের মতো কমেছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স, জিপিএইচ ইস্পাত, ট্রাস্ট ব্যাংক, ফরচুন সুজ ও বিবিএস কেব্‌লস। এসব কোম্পানির লেনদেনযোগ্য শেয়ারের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাজার মূলধনও বেশি। ফলে এসব শেয়ারের দাম বাড়লে বা কমলে তাতে সূচকের উত্থান-পতন ঘটে।বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে প্রথম দিন হিসেবে হয়তো বিভিন্ন মহল উদ্যোগী হয়ে বাজারে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। সে কারণে শুরুর পতনের ধারা ঠেকানো গেছে। তিনি বলেন, বাজার তার নিজস্ব গতি ফিরে পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তারপরই বলা যাবে, বাজারের গতিপথ কোন দিকে যাচ্ছে।

Share this news