শেয়ারবাজার চলছে অস্থায়ী সিদ্ধান্তে, সুফল নেই

Date: 2024-04-23 06:00:09
শেয়ারবাজার চলছে অস্থায়ী সিদ্ধান্তে, সুফল নেই
অ্যাডহক (অস্থায়ী) ভিত্তিতে নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে শেয়ারবাজার দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হচ্ছে না বলে মনে করেন বাজার অংশীজনেরা। তাঁরা বলছেন, বাজার উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। ভালো কোম্পানির অভাব দীর্ঘদিনের। সুশাসনেরও ঘাটতি তীব্র। পাশাপাশি শেয়ারের বিপরীতে দেওয়া ঋণসুবিধা (মার্জিন ঋণ) বাজারের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে সুফল মিলবে না। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব সমস্যার কথা তুলে ধরেন বাজার অংশীজনেরা। শেয়ারবাজারের চলমান দরপতন ঠেকাতে এ বৈঠকের আয়োজন করে বিএসইসি। অংশ নেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম তারিকুজ্জামান, ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম, মার্চেন্ট ব্যাংকারদের সংগঠন বিএমবিএর সভাপতি মাজেদা খাতুনসহ শেয়ারবাজারের শীর্ষস্থানীয় ১০টি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিএসইসি কার্যালয়ে এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ। সভায় বিএসইসির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকের খবরে গতকাল শেয়ারবাজারে সূচক বেড়েছে। প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এদিন ২১ পয়েন্ট বেড়েছে। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকটি বেড়েছে ৬৪ পয়েন্ট। দুই বাজারে সূচক বাড়লেও লেনদেনের ক্ষেত্রে ছিল ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা। ঢাকার বাজারে লেনদেন বাড়লেও কমেছে চট্টগ্রামের বাজারে। ডিএসইতে গতকাল দিন শেষে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৫৭৫ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ৯৭ কোটি টাকা বেশি। চট্টগ্রামে এদিন লেনদেন হয় ১১ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ৬ কোটি টাকা কম।গতকালের বৈঠকের পর বিএসইসির এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক আয়োজনের মতামত উঠে এসেছে। পাশাপাশি বাজারের সব সমস্যা সমাধানে বিএসইসি ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছে।এদিকে বাজার টেনে তুলতে গতকালের বৈঠকে উপস্থিত অংশীজনদের কাছে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানায় বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ আহ্বানে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন সভায় অংশ নেওয়া ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীরা। তবে তাঁরা এটাও বলেছেন, বড় বড় সমস্যার সমাধান করা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে বাজার টেকসই হবে না। বাজারের বড় বড় যেসব সমস্যার কথা বৈঠকে তুলে ধরা হয়, সেগুলোর সমাধানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়।বৈঠকে উপস্থিত একাধিক শীর্ষ নির্বাহী প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, সেগুলো বিএসইসি শীর্ষ পর্যায়ে অবহিত করা হবে বলে জানানো হয়। আর কিছু বিষয়ে কমিশন কাজ করছে বলে তাঁদের জানানো হয়েছে।জানা গেছে, বৈঠকে একাধিক শীর্ষ নির্বাহী বলেছেন, মার্জিন ঋণ সমস্যা বর্তমানে বাজারের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনার জন্য যত সহজে বিনিয়োগকারী ঋণ পান, অন্য কোনো ক্ষেত্রে এত সহজে ঋণ পাওয়া যায় না। ব্যাংক থেকে একটি ক্রেডিট কার্ড নিতেও নানা ধরনের কাগজপত্র ও যোগ্যতা লাগে। কিন্তু সেখানে শেয়ারবাজারে শতকোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয় বাছবিচার ছাড়াই। এতে বাজারে যখনই দরপতন শুরু হয়, তখনই ঋণ সমন্বয়ে ফোর্সড সেল বেড়ে যায়। এ সমস্যার সমাধান করা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না। এ কারণে মার্জিন ঋণনীতিতে আমূল পরিবর্তন দরকার বলে বৈঠকে একাধিক অংশীজন মত দেন।নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের বিপরীতে ঋণসুবিধা পান। ঋণদাতা বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক এ ঋণসুবিধা দিয়ে থাকে। বর্তমানে একজন বিনিয়োগকারী ঋণযোগ্য কোনো শেয়ারে নিজে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে তার বিপরীতে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা ঋণসুবিধা পান। শেয়ার বন্ধক রেখে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই এ ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। তাই শেয়ারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার নিচে নামলে ঋণ আদায়ে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহককে না জানিয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেন। এটি শেয়ারবাজারে ফোর্সড সেল বা জোর করে বিক্রি হিসেবে পরিচিত।২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুল ঋণ আটকে গেছে। এসব ঋণ আদায় হচ্ছে না, আবার ঋণ নেওয়া অনেক বিনিয়োগকারীরও কোনো হদিস নেই। অথচ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এসব ঋণকে হিসাবভুক্ত করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক সময় অনাদায়ি এসব ঋণ হিসাব নিয়েও নানা ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। এ কারণে ঋণনীতির আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয় গতকালের বৈঠকে।বৈঠকে এক ব্রোকারেজ হাউস মালিক বলেছেন, শেয়ারবাজার পড়তে থাকলেই ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। অথচ শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে। কিন্তু গত তিন দশকে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে এত বেশি অনিয়ম হয়েছে যে এ খাতটি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করতে হলে মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে শক্তিশালী করতে হবে।বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাজারের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ভালো শেয়ারের সরবরাহ বৃদ্ধি, সুশাসনের উন্নতি, মার্জিন ঋণনীতির আমূল পরিবর্তন, মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে শক্তিশালী করা না গেলে দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে সুফল মিলবে না বলে জানিয়েছেন অনেকে।

Share this news