পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা

Date: 2023-03-27 10:00:34
পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা
পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। গত আড়াই বছর বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এক টাকাও বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। উল্টো অতীতে যে বিনিয়োগ এসেছিল, সেগুলোও বিক্রি করে দিয়ে টাকা দেশে নিয়ে যাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারের যে বেহাল দশা তার জন্য বিদেশি বিনিয়োগের এই করুণ দশাও একটি কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট বিনিয়োগের (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটি কমে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে নেমে আসে মাত্র ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ২৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়। অর্থাৎ ওই বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যতো বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল, তার থেকে প্রায় ২৭ কোটি ডলার বেশি চলে যায়।গত ২০২১-২২ অর্থবছরেও সেই ঋণাত্মক ধারা অব্যাহত থাকে; বছর শেষে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ২০ কোটি ডলারের মতো ঋণাত্মক হয়। সর্বশেষ চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পুঁজিবাজারে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই তথ্যই বলছে, গত আড়াই বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে নতুন কোনো বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।অথচ দেশে সার্বিক বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। দুই বছরের করোনা মহামারির পর এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো হোঁচট খেলেও বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৩০৬ কোটি ৬০ লাখ (৩.০৭ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই সাত মাসে ২৭৩ কোটি (২.৭৩ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই সাত মাসে দেশে নিট এফডিআই বেড়েছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। ১৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে দেশে। গত বছরের এই সময়ে এসেছিল ১২৯ কোটি ডলার।গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ (৪.৭১ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই বেড়েছিল আরও বেশি, ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট এফডিআই এসেছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব পড়ছে বিদেশি বিনিয়োগে। সংকটের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বলছেন তারা। বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এফডিআই আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। কিন্তু এই ইতিবাচক ধারার মধ্যে পুঁজিবাজারে বিদেশি না আসায় হতাশ হয়েছেন তারা। দীর্ঘদিন ধরে চলা বাজারের মন্দাবস্থাই এর কারণ বলে মনে করছেন তারা।পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো পুঁজিবাজারে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ থাকা ভালো। আমাদের বাজারেও তেমনটাই ছিল। কিন্তু ২০০৯-১০ সালে বাজারে বড় ধসের পর ৪-৫ বছর বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না বললেই চলে। ২০১৫ সাল থেকে কিছুটা আসতে শুরু করে। মাঝে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভালোই বিনিয়োগ করেছিল। ২০২০ সালে বাজারে যে একটা ধস হয়েছে সে আতঙ্কে অনেকে চলে গেছে। আর আসেনি। এখন সামান্য যে বিদেশি বিনিয়োগ আছে, সেটা আগে বিনিয়োগ করা। বাজার সুস্থ-স্বাভাবিক না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবে না বলে জানান তিনি।বিদেশি বিনিয়োগের এই করুণ দশা নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘২০২১ সালের প্রথমার্ধে কিছুদিন আমাদের বাজার ভালো ছিল। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছিল; বেশির ভাগ শেয়ারের দাম চড়া ছিল। ওই চড়া বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ করেনি। বরং মুনাফা তুলে নিতে হাতে থাকা শেয়ারগুলোই বিক্রি করে দিয়েছেন। এরপর থেকে বাজারে আর নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। সে কারণে নিট বিনিয়োগ অনেক দিন ধরে নেগেটিভ রয়েছে।’আন্তর্জাতিক বড় বড় বাজারের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসলে অনেক কিছু চিন্তা করে বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অডিটসহ স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্টক এক্সচেঞ্জের পারফর্মমেন্স ইত্যাদি। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে আমাদের পুঁজিবাজার দুই মাসের বেশি বন্ধ ছিল। এটা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পছন্দ করেনি। মূলত সে সময়ের পর থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করেনি।’ তবে এখনো কয়েকটি ভালো কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে বলে জানান স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী।পুঁজিবাজার বিশ্লেষক শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হাসান বলেন, ‘প্রথম প্রথম যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন সেটা করেছেন মূলত ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। এক বছরের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ৮৬ টাকার ডলার এখন ১০৭ টাকায় উঠেছে। সব দেশেই ডলারের বাজার অস্থির থাকলে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়। কেননা, ডলারের দাম বেশি থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার বিক্রি করেন তখন তারা আগের চেয়ে কম পরিমাণ ডলার নিয়ে যেতে পারেন। আমাদের বাজারে সেটাই হয়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় নতুন কোনো বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ নিয়ে আসেনি। এর মধ্যেও কিছু বিনিয়োগ আসতে পারত। কিন্তু পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইজ থাকার কারণে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।’২০১০ সালের মহাধসের এক দশক পর ২০২০ সালের ১৭ মে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে চেয়ারম্যান করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়। এরপর বাজার চাঙা করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়। মাঝেমধ্যে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। দিন যত গেছে বাজারের অবস্থা ততই খারাপ হয়েছে। এখন অবস্থা খুবই খারাপ; লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। গতকাল বুধবার দেশের প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৩২৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে; প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৬ পয়েন্টের বেশি। মাঝে এই বাজারে লেনদেন ২০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছিল।দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রোড শোর আয়োজন করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। কিন্তু তার কোনো ইতিবাচক ফল এখনো বাজারে পড়তে দেখা যায়নি।-দৈনিক বাংলা।

Share this news