পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইসে আটকা ২২৪ কোম্পানির

পুঁজিবাজার ফ্লোর প্রাইসে (সর্বনিম্ন মূল্যস্তরে) আটকে যাওয়া কোম্পানির সংখ্যা বাড়ছেই। বেশির ভাগ শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকায় পুঁজিবাজারে গতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তায় কমছে সূচক ও লেনদেন।ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারের দামে উত্থান-পতন হচ্ছে না।এতে ক্রেতাও মিলছে না। দীর্ঘ সময় চোরাবালিতে আটকে যাচ্ছেন অনেক বিনিয়োগকারী। ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে বাজারে ব্যাপক পতন হবে—এমন আশঙ্কা পুঁজিবাজারকে জটিল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই পুঁজিবাজারে গতি আনতে সর্বনিম্ন মূল্যস্তর তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।কেন ফ্লোর প্রাইসপুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রথমবার ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়, যা পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয় ২০২১ সালের ১৭ জুলাই। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গত বছরের ১ মার্চ সব শেয়ারের দরে নিচের সার্কিট ব্রেকার ২ শতাংশ বেঁধে দেয় সংস্থাটি। এ ব্যবস্থা কাজ না করায় গত বছরের ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় সব শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে সংস্থাটি।২২৪ কম্পানি, এক সপ্তাহে বেড়েছে ১৬ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৩০ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইসের প্রতিষ্ঠান ছিল ১৯৮টি। গত সপ্তাহে ৬ থেকে ১০ আগস্ট এই সংখ্যাবেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০৮টিতে। গতকাল রবিবার প্রথম কার্যদিবসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২৪টিতে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ফ্লোর প্রাইসের প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ১৬টি।ডিএসই জানিয়েছে, গেল সপ্তাহে মাত্র ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দর বেড়েছে, ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কোনো লেনদেন হয়নি।ডিএসইর তথ্যমতে, গেল সপ্তাহে পতনের তালিকায় উঠে এসেছে ১৪৪টি প্রতিষ্ঠান। যেখানে আগের সপ্তাহের পতনের চেয়ে গত সপ্তাহের পতনের গভীরতাও ছিল বেশি।গেল সপ্তাহে বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দর কমাতে ডিএসইতে বাজার মূলধন পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওপর কমে গেছে। সেই সঙ্গে কমেছে সব মূল্যসূচক ও লেনদেন। গতকাল ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ৯.৪৭ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৬২৮৭ পয়েন্টে। রবিবার লেনদেনে অংশ নেওয়া ৩৩৫টি কম্পানির লেনদেন হয়েছে ৪২৫ কোটি টাকা।দেশে যখন প্রথমবার ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়েছিল তখন অনেক বিনিয়োগকারীই একে আশীর্বাদ হিসেবে মনে করেছিলেন। তাঁদের অনেকে এখন ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলো যদি দেখে পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগ আটকে যেতে পারে, তাহলে তারা আর বিনিয়োগ করবে না। এটি বাজারে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ফ্লোর প্রাইস কোনো সমাধান নয়, বরং এটি ‘গলার কাঁটা’।অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা যা বলছেনঅর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে ভীতি আছে, ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নিলে অহেতুক বড় রকমের দরপতন হবে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরো কমে যেতে পারে। কম্পানিগুলোর দরপতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। কোনো কোনো পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস সীমিত সময়ের জন্য দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘদিন হয়ে গেছে। পরিস্থিতি বুঝে এটা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা থাকা উচিত।’পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওসমান ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনের বছরে বর্তমানে অর্থনীতির যে অবস্থা তার প্রভাব পুঁজিবাজারেও পড়েছে। এর সঙ্গে ফ্লোর প্রাইস যুক্ত হওয়ায় পুঁজিবাজার পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। লভ্যাংশ মৌসুমে ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে দরপতনের আশঙ্কা কম থাকে। ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে প্রথমে কিছুটা দরপতন হতে পারে। তবে তা আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। পুঁজিবাজারের গতি সঞ্চার করতে পর্যায়ক্রমে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।’যা বলছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাবিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফ্লোর প্রাইস তুলে নেবে।জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা দরপতনে যাতে ফোর্স সেলের শিকার না হন এবং তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছে কমিশন। পুঁজিবাজার আরো ভালো না হওয়া পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস থাকবে।’ফ্লোর প্রাইসের কম্পানি বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, ‘বাজার এখন নিম্নমুখী হওয়ায় ফ্লোর প্রাইসে থাকা কম্পানির সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে কারো কারো তহবিল আটকে গেছে। বিনিয়োগকারীরা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে থাকায় লেনদেন কমে গেছে। আবারও শেয়ারবাজার চাঙ্গা হলে এই সংখ্যা কমে আসবে বলে আশা করি।’