ওটিসির কাগজের শেয়ারের সিন্ডিকেটে অস্থির শেয়ারবাজার

Date: 2022-11-15 04:00:25
ওটিসির কাগজের শেয়ারের সিন্ডিকেটে অস্থির শেয়ারবাজার
ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটের বেশকিছু কোম্পানিকে এসএমই ও এটিবি মার্কেটে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।এ সুযোগকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে বড় সিন্ডিকেট। তাদের নিজস্ব এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাগজের শেয়ারের কৃত্তিম সংকট তৈরি করে বিভিন্ন গল্প ছড়িয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এ চক্রটি। এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছে শেয়ারবাজারের এক সময়ের আলোচিত গেম্বলার আনিস। তিনি এখন ওটিসি আনিস নামে পরিচিত। এছাড়াও সালাউদ্দিন হায়দার, খোরশেদ আলম, মির্জা আসলাম আলী এবং সাজিদ রহমান এই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মতিঝিলে অবস্থিত ডিএসইর পুরনো অফিসের এই সিন্ডকেটের স্বর্গরাজ্য।daraz-300x300অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নামসর্বস্ব এসব কাগুজে কোম্পানির শেয়ারে মূল বাজারের একটি বড় অংশের বিনিয়োগ আটকে রয়েছে।যদিও ডিএসইতে এখন পর্যন্ত একটি কোম্পানিও পুনরায় লেনদেনের জন্য আবেদন করেনি।ডিএসইর দাবি এসব কোম্পানির অধিকাংশেরই কোন অস্তিত্ব নেই। আর অতি উচ্চমুল্যে এসব শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গত এক বছরে শেয়ারবাজার থেকে বড় অংকের অর্থ তুলে নিয়েছে এ চক্রটি। ফলে বাজারে তারল্য সংকটের জন্য এসবকেও দায়ী করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।এদিকে অর্থসংবাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য । এটিবি ও এসএমইর তালিকায় থাকা কয়েকটি কোম্পানির জমিসহ স্থাবর সম্পত্তি নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে। ফলে নামে মাত্র কোম্পানি বা কাগুজে কোম্পানি হওয়াতে শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পাওয়া এখন অনিশ্চিত। এর মধ্যে এসএমই মার্কেটে লেনদেন চালু হলেও এটিবি মার্কেটে স্থানান্তরিত কোম্পানিগুলো এখনো একটিরও লেনদেন পুনরায় শুরু হয়নি। তবে এটিবি মার্কেটে স্থানান্তর হওয়া বেশকিছু কোম্পানির হদিস পাওয়া যায়নি অর্থসংবাদের অনুসন্ধানে।ডিএসইতে দেওয়া কোম্পানিগুলোর ঠিকানায় দিয়ে দেখা মেলে অন্য প্রতিষ্ঠানের। আবার কয়েকটি কোম্পানির সম্পদ নিলামে বিক্রি হওয়ায় সেগুলো কাগুজে প্রতিষ্ঠানে রুপ নিয়েছে। অথচ এসব কোম্পানির শেয়ার একটি চক্র কুক্ষিগত করে সেগুলো চড়া দামে বিক্রির পায়তারা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরঞ্জিত হয়ে অস্তিত্বহীন কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে বিনিয়োগকারীদের।জানা গেছে, গত বছরের (২০২১) ২১ সেপ্টেম্বর দেশের উভয় শেয়ারবাজার (ডিএসই ও সিএসই) থেকে ওটিসি মার্কেট বাতিল করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ওটিসির ৭০টি কোম্পানির মধ্যে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি। ২৩ কোম্পানিকে এসএমই প্লাটফর্মে স্থানান্তর করা হয়। আর বাকি ১৮টি কোম্পানিকে স্থানান্তর করা হয় অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি)।Nogod-22-10-2022বিএসইসির এ নির্দেশনার পর ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এসএমই প্লাটফর্মে লেনদেন শুরু হয়। এখনো পর্যন্ত চালু হয়নি এটিবি প্লাটফর্মে স্থানান্তর হওয়া কোম্পানিগুলোর লেনদেন। তবে এটিবিতে লেনদেনের অপেক্ষায় থাকা কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে একটি সিন্ডিকেট কারসাজি শুরু করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ অর্থসংবাদকে জানিয়েছে, এটিবির বেশিরভাগ কোম্পানির কোন অস্তিত্ব নেই, যে কয়েকটির অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলো পুনরায় শেয়ারবাজারে আসতে আগ্রহী নয়। অর্থসংবাদের অনুসন্ধানেও এটিবির বেশকিছু কোম্পানির অস্তিত্ব না থাকার তথ্য উঠে এসেছে।সূত্র মতে, ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেট থেকে ১৮ কোম্পানিকে এটিবিতে স্থানান্তর করার পর প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার কম দামে হাঁতিয়ে নেয় একটি সিন্ডিকেট। পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরণের গুজব ছড়িয়ে বেশি দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে এসব শেয়ার বিক্রি করছে চক্রটি। এক্ষেত্রে কোন কোন কোম্পানির উৎপাদন চালু হবে এমন খবর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে ছড়ানো হয়। আবার কখনো ছড়ানো হয় এটিবির কোম্পানিগুলোর মালিকানা বদলের ভুয়া তথ্য। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও সিন্ডিকেটের ফাঁদে পাঁ দিয়ে চড়া দামে এসব শেয়ার কিনে নিচ্ছে। যদিও এটিবি মার্কেটে কবে নাগাদ লেনদেন চালু হবে তাঁর সঠিক তথ্য এখনো দিতে পারেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ।এছাড়াও ওটিসির দুই কোম্পানির সম্পদ নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অর্থসংবাদের অনুসন্ধানে। এর মধ্যে একটি কোম্পানি অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে লেনদেনের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও ওটিসির আরও এক কোম্পানির সম্পদও নিলামে বিক্রি করার জন্য অর্থ ঋণ আদালতে মামলা দায়ের করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব একটি ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে কোম্পানির সম্পদ ঋণদাতা পায়। এরপর অবশিষ্ট কোন সম্পদ থাকলে তা কোম্পানির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পাবে। তবে এই তিন কোম্পানির সম্পদ বলতে শুধুমাত্র কারখানাই রয়েছে। ব্যাংক নিলামে বিক্রির পর বিনিয়োগকারীদের জন্য অবশিষ্ট কোন কিছুই নেই বা থাকবে না।বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, ড্যান্ডি ডাইং, ডাইনামিক টেক্সটাইল, মেটালেক্স কর্পোরেশন, মিতা টেক্সটাইল, মডার্ন সিমেন্ট, মনা ফুড প্রোডাক্টস, পারফিউম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, পেট্রো সিনথেটিক লিমিটেড, ফার্মাকো ইন্টারন্যাশনাল, কাশেম সিল্ক মিলস, বাংলা প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিজ, কাশেম টেক্সটাইল মিলস, রাসপিট ইনকর্পোরেশন, রোজ হেভেন বল পেন, সালেহ কার্পেট, শ্রীপুর টেক্সটাইল, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এবং মডার্ন ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার লেনদেন হবে এটিবিতে।ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মো. শফিকুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেছিলেন, এখন পর্যন্ত একটি কোম্পানিও এটিবিতে লেনদেনের জন্য আবেদন করেনি। ১৮টি কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশেরই অস্তিত্ব নেই।এটিবিতে স্থানান্তর হওয়া বেশকিছু কোম্পানিকে নিয়ে অনুসন্ধান চালায় অর্থসংবাদ। অনুসন্ধানে অস্তিত্ব মেলেনি বেশিরভাগ কোম্পানির। এর মধ্যে শ্রীপুর টেক্সটাইল মিলস্ লিমিটেডের কারখানা ২০১৪ সালে নিলামে বিক্রি করে দেয় বাংলাদেশ ডেভেলোপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)। ওটিসিতে থাকা বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের কারখানাও ২০১২ সালে নিলামে বিক্রি করে দিয়েছিল আইএফআইসি ব্যাংক। আরেক কোম্পানি আলফা টোব্যাকো লিমিটেডের কারখানাও নিলামে বিক্রির জন্য অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করেছে সোনালী ব্যাংক। এমন অবস্থায় সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে এসব অস্তিত্বহীন বা কাগুজে কোম্পানির শেয়ার বেশি দামে কিনলে বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন- এমনটাই বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।ওটিসির কোম্পানিগুলো নিয়ে যাদের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থসংবাদ। এর মধ্যে সালাউদ্দিন হায়দার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, আমি ওটিসির কোন কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা করিনি।অভিযুক্ত আনিস উদ্দিনের একাধিক নম্বরে ফোন দিয়েও সংযোগ পাওয়া যায়নি। মির্জা আসলাম আলীকে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমার কাছে তো শেয়ারই নাই। আমি শেয়ার বেচাকেনা করি না’। তবে দাবি করেন তাঁর কাছে ওটিসির কোম্পানি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআইএল) শেয়ার আছে।আরেক অভিযুক্ত সাজিদ রহমান বলেন, ওটিসিতে শেয়ার কারসাজি নিয়ে তিনি কিছু জানেন না। তবে ওটিসির কোম্পানির শেয়ার তাঁর কাছে আছে বলে জানালেও ফোনে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি।কাগজের শেয়ারের কৃত্তিম সংকট তৈরি করে বিভিন্ন গল্প ছড়িয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, অভিযোগ তদন্ত করে উপযুক্ত প্রমাণ পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।

Share this news