‘অলৌকিক’ শেয়ার : এক মাসে দাম বেড়ে দ্বিগুণ

পুঁজিবাজারে মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার যেন ‘অলৌকিক’। নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে না এবং লভ্যাংশে ধারাবাহিকতা না থাকা এ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সতর্ক বার্তাও কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়ার প্রবণতা রুখতে পারছে না। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে শেয়ার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।দুর্বল আর্থিক ভিত্তি সম্পন্ন একটি কোম্পানির শেয়ার দাম এভাবে বাড়কে অস্বাভাকি বলছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, শেয়ারের এ দাম বাড়ার পেছনে কোনো বিশেষ চক্র রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা উচিত। পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করা উচিত। তা না হলে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়তে হতে পারে।অপরদিকে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার দাম বাড়ার বিষয়টি বিএসইসির সার্ভিলেন্স টিম নিয়তম পর্যবেক্ষণ করছে। কোনো ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার দাম বাড়ানোর পেছনে আলোচিত এক বিনিয়োগকারী রয়েছেন। যিনি সরকারি চাকরিতে থেকে এর আগেও বিমাসহ অন্য খাতের কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়াতে ভূমিকা রাখেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির তদন্তে এ সরকারি কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজির বড় ধরনের তথ্য বেরিয়ে আসে। যার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দফা জরিমানাও করা হয়।তারা জানান, নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে দফায় দফায় পরিবারের সদস্যদের জরিমানা করায় একপর্যায়ে আলোচিত এ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার থেকে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নেন। তবে, এখন আবার তিনি শেয়ারবাজারে সক্রিয় হয়েছেন। মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি বিমা কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ার পেছনে তার ভূমিকা রয়েছে।তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১৬ আগস্ট মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিলো ২৮ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে এখন প্রতিটি শেয়ারের দাম ৫৭ টাকা ৪০ পয়সায় উঠিছে। অর্থাৎ এক মাসের কম সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।অন্যভাবে বলা যায়, কোনো বিনিয়োগকারী ১৬ আগস্ট কোম্পানিটির ১০ লাখ টাকার শেয়ার কিনে ধরে রাখলে এখন তার দাম দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ৫৬ টাকা। অর্থাৎ ১০ লাখ টাকা এক মাস খাটিয়েই ৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। এটাকে মিরাকেল বললে ভুল হবে না।শুধু এখানেই শেষ নয়, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ মিরাকল দেখিয়েছে আর একটি ক্ষেত্রেও। কোম্পানিটির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার বিষয়ে সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে বার্তা প্রকাশ করা হয়।ওই বার্তায় ডিএসই জানায়, শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষকে নোটিশ করা হয়। নোটিশের জবাবে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে- সম্প্রতি শেয়ারের যে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে এবং লেনদেন বেড়েছে, তার পেছনে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদশীল তথ্য নেই।ডিএসইর এ তথ্য প্রকাশ যেন কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়ার পালে আরও হাওয়া লাগিয়েছে। মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার দাম দিনের সর্বোচ্চ পরিমাণ বেড়েছে। প্রতিটি শেয়ার দাম ৫ টাকা ২০ পয়সা বা ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেড়েছে। একদিনে কোম্পানিটির শেয়ার দাম এর থেকে বেশি বাড়ার সুযোগ ছিল না। এমনকি লেনদেনের একপর্যায়ে দিনের সর্বোচ্চ দামে কোম্পানিটির বিপুল শেয়ার কেনার আদেশ আসে, অপরদিকে বিক্রয় আদেশের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে।শেয়ারের এমন দাম বাড়া কোম্পানিটি ২০০০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০২১ সালের মার্চের পর কোম্পানিটি কোনো আর্থিক প্রবেদন প্রকাশ করিনি। সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ২১ পয়সা লোকসান করে। এ আর্থিক তথ্য প্রকাশের আগে ২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের জন্য কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়।৩৫ কোটি ২১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা ৩ কোটি ৫২ লাখ ১৮ হাজার ৫৭টি। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ আছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ শেয়ারই আছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।ডিএসইর এক সদস্য বলেন, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার দাম যেভাবে বেড়েছে, তাকে কিছুতেই স্বাভাবিক বলা যায় না। শেয়ারের এ দাম বাড়াতে কোনো বিশেষ চক্র থাকতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা উচিত। যদি কেউ কারসাজির মাধ্যমে শেয়ার দাম বাড়ায়, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে না।