মন্দার শঙ্কায় বৈশ্বিক পুঁজিবাজারে দরপতন

গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শুক্রবার এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশে দেশে সুদহার বাড়ানোর কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পরিস্থিতির তীব্রতা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সামনের দিনগুলোয় সুদহার আরো বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে বৈশ্বিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। এতে ইউরোপ-আমেরিকায় মন্দার শঙ্কা ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে, যার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।ইউরোপের অন্যতম পুঁজিবাজার যুক্তরাজ্যের এফটিএসই ১০০ সূচক ও জার্মানির ব্লুচিপ সূচক ডিএএক্স গত শুক্রবার ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে ফ্রান্সের সিএসি ৪০ সূচক কমেছে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ। এছাড়া ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, গ্রিস, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, হাঙ্গেরি, স্পেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া ও সুইডেনের পুঁজিবাজারও এ সময়ে পয়েন্ট হারিয়েছে।গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ সূচক কমেছে ১ দশমিক ৬২ শতাংশ। একই সময়ে দেশটির এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ১ দশমিক ৭২ ও নাসডাক সূচক ১ দশমিক ৮০ শতাংশ পয়েন্ট হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি এ অঞ্চলের আর্জেন্টিনা, পেরু, কানাডা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, চিলি ও কলম্বিয়ার পুঁজিবাজারের সূচক কমেছে।ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি গত শুক্রবার এশিয়ার পুঁজিবাজারেও দরপতন হয়েছে। এশিয়ার অন্যতম প্রধান পুঁজিবাজার জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচক দশমিক ৫৮ শতাংশ পয়েন্ট হারিয়েছে। এ সময়ে ভারতের বিএসই সেনসেক্স সূচক ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমেছে। ভিয়েতনামের হ্যাং সেং সূচক ১ দশমিক ১৮ ও চীনের সাংহাই সূচক দশমিক ৬৬ শতাংশ পয়েন্ট হারিয়েছে এ সময়। এছাড়া হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার পুঁজিবাজারেও দরপতন হয়েছে।গত শুক্রবার মধ্যপ্রাচ্যের পুঁজিবাজারে নিম্নমুখিতা দেখা গিয়েছে। এ সময় সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, ওমান ও কুয়েতের পুঁজিবাজারের প্রধান সূচকগুলো ছিল নিম্নমুখী।বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ১৯৮১ সালের পর এবারই প্রথম মুদ্রানীতিকে আরো কঠোর করেছে। টানা তৃতীয়বারের মতো তারা সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। সামনের মাসগুলোয় এ হার আরো বাড়ানোর বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। একইভাবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড গত বৃহস্পতিবার সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে। দেশটির মুদ্রা পাউন্ড ডলারের বিপরীতে দর হারিয়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে ইউরোপের দীর্ঘদিনের ঋণাত্মক সুদহার যুগের অবসান হয়েছে। একইভাবে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নরওয়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সুদহার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সুদহার বাড়ানো হলেও এতে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ার মাধ্যমে মন্দার শঙ্কা বাড়ছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের নিম্নমুখী প্রবণতাও বিনিয়োগকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। এরই মধ্যে অনেক বিশ্লেষক কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাওয়ার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। মন্দার শঙ্কায় জ্বালানি তেলের দামও পড়তির দিকে। বৈশ্বিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়লেও তেলের চাহিদাও কমে আসবে, এমন ধারণার কারণে এর দাম কমছে। একইভাবে স্বর্ণের দামও কমছে। সুদহার বাড়ানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড ইল্ডের হার বর্তমানে ঊর্ধমুখী। সব মিলিয়ে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্বকে বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কা প্রভাবিত করেছে, যা বাজারের দরপতনকে ত্বরান্বিত করেছে।দেশের পুঁজিবাজার পরিস্থিতি: গত সপ্তাহে দেশের পুঁজিবাজারে সূচকের ঊর্ধ্বমুখিতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এ সময়ে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও বেড়েছে। তবে আলোচ্য সপ্তাহে এক্সচেঞ্জটির ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অধিকাংশ খাতে নেতিবাচক রিটার্ন এসেছে। দেশের আরেক পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) গত সপ্তাহে সূচকের পাশাপাশি লেনদেন বেড়েছে।বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত সপ্তাহে ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স আগের সপ্তাহের তুলনায় ৪৮ দশমিক ৯৯ পয়েন্ট বা দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। সূচকটির বর্তমান অবস্থান ৬ হাজার ৫৬৪ পয়েন্টে, আগের সপ্তাহ শেষে যা ছিল ৬ হাজার ৫১৫ পয়েন্টে। ডিএসইর অন্য সূচকের মধ্যে নির্বাচিত কোম্পানির সূচক ডিএস-৩০ সপ্তাহের ব্যবধানে ১৯ দশমিক ৩৩ পয়েন্ট বা দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৩৬৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে, আগের সপ্তাহ শেষে যা ছিল ২ হাজার ৩৪৬ পয়েন্টে। শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ৭ দশমিক ১৭ পয়েন্ট বা দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৪৩৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে, আগের সপ্তাহ শেষে যা ছিল ১ হাজার ৪৩০ পয়েন্টে। ডিএসইতে গত সপ্তাহে মোট ৩৯৬টি কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড ও করপোরেট বন্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৮৬টির, কমেছে ১৩৪টির আর অপরিবর্তিত ছিল ১৩৪টির। এছাড়া লেনদেন হয়নি ১০টির।অন্যদিকে সিএসইতে গত সপ্তাহে সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেড়ে ১৯ হাজার ৩৪৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে, আগের সপ্তাহে যা ছিল ১৯ হাজার ১৪১ পয়েন্টে। সিএসসিএক্স সূচকটি গত সপ্তাহ শেষে ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেড়ে ১১ হাজার ৫৯৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আগের সপ্তাহ শেষে সূচকটির অবস্থান ছিল ১১ হাজার ৪৭৩ পয়েন্টে। সিএসইতে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে ৪০৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে যেখানে লেনদেন হয়েছিল ১৪৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আলোচ্য সময়ে সিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৩৭টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৯২টির, কমেছে ১১৬টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১২৯টির।