লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদর কারসাজিতে সর্বোচ্চ!

দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ থাকার পর কারখানা চালু করলেও ব্যবসায় লোকসান এবং উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ না থাকায় পর্ষদ পুনর্গঠনসহ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলসের বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একই সঙ্গে গত চার বছরে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ১ টাকাও আয় করতে পারেনি এবং শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ছিল ১০ টাকার নিচে। যা কোম্পানির শেয়ারের অভিহিত মূল্যের (ফেস ভ্যালু) নিচে। এতে বছরের পর বছর ভালো লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বিনিয়াগকারীরা।এমন অবস্থায়ও কারসাজি থেমে নেই কোম্পানিটির শেয়ারে। প্রতিনিয়ত কারসাজির কারণে লোকসানে থাকা কোম্পানিটির শেয়ার দর দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেড়েছে। অথচ এ বিষয় কোনো নজর বা ভ্রুক্ষেপ নেই প্রাথমিক এবং সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও বিএসইসির। শেয়ার দর বাড়তে শুরু করলে গত দুই বছরে একবার মাত্র এর কারণ কোম্পানির কাছে জানতে চেয়েছে ডিএসই। এরপরও থামেনি শেয়ারে কারসাজি। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়নি বিএসইসি। অথচ বাজারে আলহাজ্ব টেক্সটাইলের শেয়ারে কারসাজির বিষয় সবার জানা থাকলেও এবং এই শেয়ারের দর ও লেনদেনের অস্বাভাবিক গতিবিধি দেখেও বিএসইসি কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় তাদের নজরদারির বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।একই সঙ্গে তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারসাজি সম্পর্কে না জানলেও একটি শেয়ারের দর ও লেনদেনের অস্বাভাবিক গতিবিধি দেখেও কিন্তু সেটা বুঝতে পারার কথা। কিন্তু বিএসইসি এ বিষয় কোনো সিদ্ধান্তই নিচ্ছে না, যেখানে বাজার সব সময় তাদের নজরদারিতে থাকে। আর ডিএসইও এ বিষয় বিএসইসিকে জানিয়েছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। ডিএসই না জানিয়ে থাকলে কেন জানায়নি সে বিষয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি জানিয়ে থাকে তবে বিএসইসির উচিত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া।২০২১ সালের এপ্রিল থেকে কোম্পানির শেয়ার দর বাড়তে শুরু করে। পরে বিভিন্ন সময় শেয়ার দর কমতে ও বৃদ্ধি পেলে ২০২২ সালের জুলাইয়ে ডিএসই কোম্পানির কাছে শেয়ার দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চায়। কিন্তু শেয়ার দর বৃদ্ধির পেছনে কোনো কারণ নেই বলে একই মাসে ডিএসই জবাব দেয় কোম্পানি। এরই মধ্যে এ সময় কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩২ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বেড়ে ১২৮ টাকা ৪ পয়সায় দাঁড়ায়। সে হিসেবে কোম্পানির শেয়ারদর ডিএসইর জানতে চাওয়া পর্যন্ত বেড়েছে ৯৫ টাকা ৬৮ পয়সা বা ২৯৫ শতাংশ বা প্রায় তিন গুণ। আর ১৩ ফেব্রুয়ারি (গতকাল) পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধি পেয় দাঁড়িয়ছে ১৪৯ টাকা ৬০ পয়সা। সে হিসেবে শেয়ারদর ৩২ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ছে ১১৭ টাকা ২৪ পয়সা বা ৩৬২ শতাংশ বা সাড়ে ৩ গুণের বেশি। এদিকে কোম্পানিটি ডিএসইর জানতে চাওয়া এবং তার জবাব দেয়ার দুই মাস পরেই লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এতে বিষয়টি শেয়ার কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। যে কারণে এই শেয়ার কারসাজির সঙ্গে কোম্পানির কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা তাও খতিয় দেখার জোরালো দাবি জানিয়ছেন তারা।কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোম্পানিটির চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২২) ও অর্ধবার্ষিক (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২২২) প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী অর্ধবার্ষিক প্রান্তিকে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা থেকে লোকসানে নেমেছে।তথ্য মতে, কোম্পানিটির চলতি হিসাব বছরের ৬ মাস বা অর্ধবার্ষিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ০.০৫ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ০.১২ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিটি আলোচ্য প্রান্তিকে মুনাফা থেকে লোকসানে নেমেছে।এদিকে, কোম্পানিটির চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ০.২১ টাকা হয়েছে। আগের হিসাব বছরের একই সময় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ০.০৯ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিটি আলোচ্য প্রান্তিকে মুনাফা থেকে লোকসানে নেমেছে। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৯.৪৭ টাকা।এছাড়া গত চার বছরে আর্থিক হিসেবে দেখা যায়, ২০১৮ সালে কোম্পানির ইপিএস ছিল ৪৮ পয়সা। এর পরে ২০২০ সালে শেয়ার প্রতি কোম্পানির লোকসান হয় ৯৩ পয়সা। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে কোম্পানি শেয়ার প্রতি মুনাফা করে মাত্র ২৬ পয়সা এবং সবশেষে ২০২২ সালে কোম্পানির শেয়ার প্রতি ৯১ পয়সা মুনাফা হয়। তবে কোম্পানির ২০১৯ সালের তথ্য ডিএসইর ওয়ব সাইটে পাওয়া যায়নি। আর গত চার বছরে কোম্পানিটি ১ টাকাও শেয়ার প্রতি মুনাফা করতে পারনি। এর সঙ্গে কোম্পানির এনএভি কমে ১০ টাকা বা শেয়ারের ফেস ভ্যালুর নিচে রয়েছে। কোম্পানিটি ২০১৫-১৭ সাল? পর্যন্ত মাত্র ৫ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। তবে এর সঙ্গে বিভিন্ন হারে বোনাস লভ্যাংশ ছিল। ২০২১ ও ২২ সালে কোম্পানি ১ ও ৩ শতাংশ নামমাত্র লভ্যাংশ দেয়, যা কারসাজির? সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া উল্লেখ করা বছরগুলোসহ সব বছরেই বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানি।কোম্পানিটির শেয়ারদর ও লেনদেনের অস্বাভাবিক গতিবিধির বিষয় জানতে চাইলে কোম্পানির সচিব সেলিম পারভেজ শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে শেয়ারদর বৃদ্ধি এবং লেনদেনের বিষয় আমাদের কিছু জানা নেই এবং এর পেছনে কোম্পানির কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। ডিএসই ও বিএসইসি এ বিষয় কোনো কিছু জানতে চেয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু জানতে চায়নি এবং কোনো তদন্ত করছে কি না, সে বিষয় জানা নেই।উল্লেখ, কোম্পানিটির পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদে নতুন স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান মনোনয়ন করে বিএসইসি। এ পদের জন্য বিএসইসির সাবেক কমিশনার এবং সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ খন্দকার কামালউজ্জামানকে মনোনয়ন দেয়া হয়।তথ্য মতে, এর আগে খন্দকার কামালউজ্জামান ২০২১ সালের ১ আগস্ট থেকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক অর্থ মন্ত্রণালয়র আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে বিএসইসির ‘আইন উপদেষ্টা’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি বিএসইসিতে কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি বিএসইসির মনোনীত চারজন পরিচালক আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলসে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের যোগদান করেন। স্বতন্ত্র পরিচালকরা হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়র সাবেক অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র ফাইন্যান্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাইফুদ্দিন খান এবং ঢাকা ?বিশ্ববিদ্যালয়র ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহযোগী অধ্যাপক মিলিতা মেহজাবিন। আর নতুন স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটের সিনিয়র ফ্যাকাল্টি মেম্বার মো. সেলিমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তথ্য মতে, আর্থিক অবস্থার ধারাবাহিক অবনতির কারণে আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলসের ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে আসে। দীর্ঘ দুই বছর ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে থেকেও কোম্পানিটির কোনো উন্নতি হয়নি।