লেনদেন ২৮০০ কোটি ছাড়ালেও পুঁজিবাজার কোন অবস্থানে?

দেশের পুঁজিবাজারে সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে সূচকের পতন হলেও গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। এতে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল সূচক ৪ পয়েন্ট কমেছে আর লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। তবে এদিন লেনদেনে অংশ নেয়া শেয়ার ও ইউনিটের মধ্যে বেশিরভাগের দর কমেছে, গতকাল শেয়ার ও ইউনিট দর কমেছে ১৫৬টির। বিপরীতে দর বেড়েছে মাত্র ৭২টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১৪৫টির। একই সঙ্গে ডিএসইতে ১৫ বারের মতো লেনদেন ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা অতিক্রম করলেও গতকাল ভালো শেয়ারে ক্রেতা সংকটে ছিল। এর ফলে বাজার কোন দিকে যাচ্ছে এবং বাজারের বর্তমান অবস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। তাই বাজারের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি বাড়ানো এবং আরও দায়িত্বশীল হওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।বাজার পর্যলোচনায় দেখা যায়, গতকাল লেনদেন এত বেশি হলেও ব্লচিপ বা ফান্ডামেন্টাল শেয়ার হিসেবে বিবেচিত ডিএসই-৩০ সূচকের অন্তর্ভুক্ত বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারে ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ব্র্যাক ব্যাংক, গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, সিঙ্গার বিডি, রেনাটাসহ আরও কিছু কোম্পানির শেয়ার রয়েছে। এসব শেয়ার লেনদেনের একপর্যায়ে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। বাজার চিত্রে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ার বর্তমানে ফ্লোর প্রাইসে অবস্থান করছে। সেই সঙ্গে রেনাটা, সিঙ্গার বিডি ও ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারও ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে।এদিকে গতকাল সিম বিক্রি করার অনুমতি পেয়েও গ্রামীণফোনের শেয়ার দর কমেছে। তবে স্কয়ার ফার্মার শেয়ার দর মাত্র ৫ পয়সা বেড়েছে গতকাল। অথচ বাজারে দেখা যাচ্ছে, গতকাল শেয়ারদর বাড়ার ক্ষেত্রে বাআগ্রহের শীর্ষে বেশিরভাগই রয়েছে কোনো রকম ব্যবসা চালানো বা ব্যবসার খারাপ অবস্থা, লোকসানি ও স্বল্প পরিশোধিত মূলধনি কোম্পানির শেয়ার।বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী এবং সংশ্লিষ্টরা চিন্তিত। সেই সঙ্গে বাজার কোন অবস্থানে রয়েছে এবং কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে কনফিউসড। গত কয়েকদিনের বাজারের অবস্থা দেখলে সে রকমটাই মনে হচ্ছে। না হলে যে বাজারে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে এবং লেনদেন ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, সে বাজারে ভালো কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগ শেয়ার হয় ফ্লোর প্রাইসে আছে না হয় শেয়ার দর কমতেছে। আর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভালো কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ছে খুবই অল্প। তাহলে এই বাজারকে ভালো বাজার বলা যাবে না।তারা বলেন, শুধু লেনদেন বেশি হলেই এবং অনেক বেড়ে গেলেই বাজারকে ভালো শেয়ার বলা যায় না। একটি ভালো বা আদর্শ বাজারের প্রধান বিষয় হচ্ছে, লেনদেনের সঙ্গে মৌলভিত্তিক কোম্পানি আর ব্ল–চিপ কোম্পানির শেয়ারের চাহিদা বাড়বে। বছর শেষে ভালো কোম্পানির শেয়ার থেকে বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ড গেইন এবং ক্যাপিটাল গেইন দুটোই পাবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাজারে পচা বা জাঙ্ক শেয়ার এবং স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের শেয়ারের মাধ্যমে একদল কারসাজিকারী ক্যাপিটাল গেইন করে। তাদের অনুসরণ করে হাতেগোনা দু’একজন মুনাফা করলে বেশিরভাগ পড়ে বিপদে, এতে বছর শেষে না পায় ডিভিডেন্ড। আবার যে দামে শেয়ার কিনে তার থেকে অনেক লোকসানে হয় বিক্রি করে আর না হয় সেই শেয়ার ফান্ডে আটকে থাকে। তাই বাজারে শুধু লেনদেন বাড়ানো বা স্থিতিশীল করা নয়, বাজারকে করতে হবে একটি আদর্শ পুঁজিবাজার এবং এখানে কারসাজি বন্ধ করে পচা বা জাঙ্ক শেয়ার দিয়ে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হওয়া বন্ধ করতে হবে। ভালো কোম্পানির শেয়ার এবং মৌলভিত্তি কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়াতে হবে বলে জানান তারা।এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বাজারে লেনদেন বেড়েছে কিন্তু মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারে এর প্রভাব পড়েনি। কিন্তু বেশ কিছু জাঙ্ক শেয়ারের দাম বেড়েছে। অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে, যেগুলো ভালো কোম্পানি না বা ২০-৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার সামর্থ্য নেই। সেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম মৌলিক দামের থেকে কয়েকগুণ বেশি। তাই এভাবে বাজার চলতে থাকলে এই লেনদেন খুব বেশি সময় থাকবে না। মৌলভিত্তি শেয়ারে লেনদেনের প্রভাব না থেকে যদি খারাপ শেয়ারে প্রভাব দেখা যায় তাহলে সেটা বাজারের জন্য ভালো কিছু না বলে জানান তিনি।অপরদিকে নাম না প্রকাশের শর্তে এক অর্থনীতিবিদ শেয়ার বিজকে জানান, বাজারে লেনদেন বেড়েছে কিন্তু ব্যাংক খাতে বা মৌলভিত্তি শেয়ারে কোনো মুভমেন্ট লক্ষ্য করা যায়নি। এ থেকেই বোঝা যায় বাজারে কারসাজি চক্র সক্রিয়। যার ফলে ভালো কোম্পানির বিপরীতে পচা শেয়ারের দাম কয়েকগুণ হচ্ছে। বাজারের যে লেনদেন বাড়ছে, তা হচ্ছে সেই গেম্বলারদের ফান্ড। এ বিষয়টি দুই থেকে পাঁচ সপ্তাহ চললেও খুব বেশি সময় থাকবে না। তাদের কিছু নির্ধারণ করা শেয়ারে কারসাজি শেষে বের হয়ে যাবে এবং যাদের হাতে শেষে শেয়ার থাকবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে; যা বাজারের জন্য খুবই বিপজ্জনক বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।