ক্যাপিটেক গ্রামীণ ফান্ডের ইউনিটে অস্বাভাবিক লেনদেন

Date: 2023-11-01 22:00:08
ক্যাপিটেক গ্রামীণ ফান্ডের ইউনিটে অস্বাভাবিক লেনদেন
পুঁজিবাজারে সদ্য তালিকাভুক্ত মেয়াদী মিউচুয়াল ফান্ড (Close-end Mutual Fund) ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড-এর ইউনিটের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। তালিকাভুক্তির পর থেকে প্রতিদিনই প্রায় ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে ফান্ডটির ইউনিটের দাম; ছুঁয়েছে সার্কিটব্রেকারের সর্বোচ্চ সীমা। মাত্র ১০ কার্যদিবসে ইউনিটের দাম বেড়ে ১৫৬ শতাংশ।মঙ্গলবার অক্টোবর মাসের শেষ কার্যদিবসে ফান্ডটির মূল্য দাঁড়ায় ২৫ টাকা ৬০ পয়সা, যা তার ইউনিট প্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) আড়াই গুণ প্রায়।বাজার বিশ্লেষকরা ফান্ডটির ইউনিটের টানা মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সন্দেহজনক ও ঝুঁকিপুর্ণ মনে করছেন। তাদের মতে, বিশ্বজুড়ে মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট সাধারণত তার এনএভির ১০ শতাংশ বেশি দাম বা কম দামের মধ্যে কেনাবেচা হয়ে থাকে। মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কোনো ইক্যুইটি শেয়ার নয়। ইক্যুইটি শেয়ার নিয়ে অনেক স্পেকুলেশন হয়। তাছাড়া কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ব্যবসাবহুমুখীকরণসহ নানা ধরনের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবসা সম্প্রসারণের কোনো সুযোগ থাকে না। এই ফান্ডের টাকা মূলত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগ থেকে মূলধনী মুনাফা ও লভ্যাংশ আয় থেকে ইউনিটধারীদের লভ্যাংশ দেওয়া হয়ে থাকে। মেয়াদ শেষে ফান্ডের অবসায়ন ঘটে এবং এনএভির ভিত্তিতে ইউনিটধারীদেরকে অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। তাই এনএভির চেয়ে অনেক বেশি দামে ইউনিট কিনলে বড় ধরনের লোকসানের আশংকা থাকে।LankaBangla securites single pageদেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে গত ১৭ অক্টোবর ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ডের ইউনিট কেনাবেচা শুরু হয়। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজারে আসা ফান্ডটির আকার ১৫৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ফান্ডের উদ্যোক্তা গ্রামীণ ব্যাংকের অংশ ১০০ কোটি টাকা। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫০ কোটি টাকার ইউনিট কিনেছে সিটি ব্যাংক লিমিটেড। বাকী ৫ কোটি ৬৮ টাকা বিনিয়োগ করেছে অন্যান্য বিনিয়োগকারী।লেনদেন শুরুর প্রথম দিনেই ফান্ডটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ইউনিটের দাম ১০ শতাংশ বেড়ে ১১ টাকায় উন্নীত হয়। তখন থেকে প্রতিদিনই এর ইউনিটের দাম প্রায় ১০ শতাংশ করে বেড়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জে বিদ্যমান সার্কিটব্রেকার ব্যবস্থা অনুসারে, এই ধরনের ইউনিট বা শেয়ারের দাম একদিন সর্বোচ্চ ১০ শতা্ংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আলোচিত ফান্ডের ইউনিটের দাম প্রতিদিনই সার্কিটব্রেকার স্পর্শ করেছে।ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, গত বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড এর ইউনিট প্রতি সম্পদ মূল্য বা এনএভি ছিল ১০ টাকা ৩ পয়সা। মঙ্গলবার ডিএসইতে এই ফান্ডের ইউনিট তার এনএভির চেয়ে ১৫ টাকা ৫৭ পয়সা বা ১৫৫ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি দামে কেনাবেচা হয়েছে।ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ডের ইউনিটের লেনদেনর এমন আচরণের প্রেক্ষিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে সোমবার (৩০ অক্টোবর) ফান্ডটির সম্পদ ব্যবস্থাপক ক্যাপিটেক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের কাছে মূল্য বৃদ্ধির কোনো কারণ আছে কি-না জানতে চায়। জবাবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, ইউনিটের দাম ও লেনদেন বৃদ্ধির মতো অপ্রকাশিত কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য তাদের কাছে নেই।মঙ্গলবার লেনদেনের শুরুতেই ডিএসই এই তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দেয়। ধারণা করা হচ্ছিল, তাতে উত্তাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। এ খবর যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। খবরটি প্রকাশের কিছুক্ষণের মধ্যেই এটি লেনদেনে শীর্ষ ২০ কোম্পানি ও ফান্ডের তালিকায় উঠে আসে। যদিও পরে সে অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি, তবু আজকেই এ যাবতকালের মধ্য সর্বোচ্চ ইউনিট লেনেদন হয় এই ফান্ডের। ফান্ডটির ইউনিটের লেনদেনর এই আচরণ কারসাজির আভাসকে আরও তীব্র করে তুলেছে।বিশ্বজুড়ে সাধারণ মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট তার এনএভির চেয়ে ১০ শতাংশের চেয়ে বেশি দামে কেনাবেচা হয় না। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা এনএভির চেয়ে কিছু কম দামে কেনাবেচা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বেশিরভাগ মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট তার এনএভির চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কম দামে লেনদেন হয়। আর এর পেছনে রয়েছে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ, মূলধনী মুনাফার (Capital Gain) এর প্রতি অতিমাত্রায় ঝোঁক, সচেতনতার অভাব এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা। যদিও কয়েকটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি যথেষ্ট স্বচ্ছতা বজায় রাখছে এবং পারফরম্যান্সের ট্র্যাক রেকর্ডও ভাল-তবু বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী সকল মিউচুয়াল ফান্ডকে একই পাল্লায় মাপতে অভ্যস্ত।এই বাস্তবতায় ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ডের ইউনিটের টানা মূল্য বৃদ্ধি এবং এনএভির ১৫৫ শতাংশ বেশি দামে এর কেনাবেচাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক মনে করছেন না বাজারবিশেষজ্ঞরা। তাদের সন্দেহ, এর পেছনে বড় ধরনের কারসাজি থাকতে পারে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা না বুঝেই তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে। এমন চলতে থাকলে একসময় নিশ্চিত তাদের হাত পুড়বে। সময় থাকতেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। নইলে বিষয়টি শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির কারণ হবে না, দেশের নাজুক মিউচুয়াল ফান্ড খাতের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষুণ্ন করতে পারে।তারা বিনিয়োগকারীদেরও সতর্ক করে বলেছেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার আগে জেনেবুঝে আসা উচিত। ইক্যুইটি শেয়ার আর মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারলে, পুঁজিবাজারে আসাই উচিত নয়। এখন যারা অযৌক্তিক ও উচ্চ মূল্যে এই ফান্ডের ইউনিট কিনছেন, মূল্য সংশোধনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের গালিগালাজ করবেন। তাতে কিন্তু হারানো টাকা আর ফেরত আসবে না।এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ অর্থসূচককে বলেন, আমি প্রতিদিনই দেখেছি এটি (ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড) হ্যাং হয়ে আছে। বাড়তে বাড়তে ইউনিটের দাম প্রায় দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা কি দেখে এখানে ইনভেস্ট করছে আমি জানি না। অন্যান্য মিউচ্যুয়াল ফান্ড যেখানে নেট ভ্যালুর অনের নিচে এবং ৯০ ভাগ মিউচ্যুয়াল ফান্ডে কোনো লেনদেন হয় না। যেখানে প্রায় সবগুলো মিউচ্যুয়াল ফান্ডই আস্থাহীনতায় ভুগছে, সেখানে এই ফান্ড কি এমন জাদু দেখাবে আমি জানি না! তাদের কাছে কি আলাউদ্দিনের চেরাগ আছে?এই মার্কেটে যে ফান্ডগুলো আছে তারা কেউ ইতিবাচক পারফরম্যান্স করতে পারছে বলে আমার মনে হয় না। কালে-ভদ্রে দু’একটা ফান্ড ভালো করলেও, তারা একটাতে মানি মেক করে, আরেকটাতে হারায়। তাহলে এই নতুন ফান্ড কোথা থেকে ইনকাম করবে এবং কিভাবে বিনিয়োগকারীকে রিটার্ন দিবে? বিনিয়োগকারী বিনা কারণে মাঝে মাঝে কিছু ইন্সট্রুমেন্টের পেছনে দৌড়ায়, এ ক্ষেত্রেও আমার তেমনটিই মনে হচ্ছে। না বুঝে বিনিয়োগকারীরা এর পেছনে দৌড়াচ্ছে। আবার এটি একটি গেম্বলিং ইন্সট্রুমেন্টও হতে পারে। এটার পারফরম্যান্স না দেখেই এতে বিনিয়োগ করছে বিনিয়োগকারীরা। আর এটা যেহেতু নতুন এসেছে এর পারফারম্যান্স ই বা কোথা থেকে আসবে? যেখানে আগেই বাজারে উল্লেখযোগ্য কিছু মিউচ্যুয়াল ফান্ড রয়েছে আর তারাই কিছু করতে পারছে না, সেখানে এদের হাতে কি কোন ম্যাজিক পাওয়ার আছে?ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ডের ইউনিটের ইউনিটের টানা মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাপিটেক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজুর রহমান অর্থসূচককে বলেন, বাজারে ফান্ডটির ইউনিটের দাম কেন এভাবে বেড়ে চলেছে, তা আমরা জানি না। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এটি আমাদের কাজও না। আমাদের দায়িত্ব ফান্ডটি ভালভাবে পরিচালনা করা, যাতে বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ রিটার্ন দেওয়া সম্ভব হয়, আমরা সে কাজটিই করার চেষ্টা করছি।

Share this news