কর্তার প্রশ্রয়ে মহালুটের প্রস্তুতি

Date: 2023-01-01 20:00:14
কর্তার প্রশ্রয়ে মহালুটের প্রস্তুতি
পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আলিফ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছ ও বানোয়াট তথ্যে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানিটি যে টার্নওভার দেখিয়েছে তার পক্ষে কোনো সহায়ক নথি নেই। শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হলেও কোনো রপ্তানি প্রক্রিয়ার সনদ (এক্সপোর্ট প্রসিড সার্টিফিকেট) নেই। ব্যাংকের কাছ থেকে কোনো নগদ সহায়তাও আসেনি। কখনো আমদানির ঋণপত্রও খোলেনি তারা। কোম্পানিটি তাদের উৎপাদন চালু দেখালেও কোনো প্রশাসনিক ব্যয় দেখায়নি। এমন কোম্পানিকেই ঢালাওভাবে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন কমিশনের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা, যার প্রশ্রয়ে এবার ব্যাপক লুটপাটের আয়োজন করেছে আলিফ গ্রুপ।আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের বানানো আর্থিক প্রতিবেদন যাচাইয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) তদন্ত কমিটি গঠন করলেও কোম্পানিটির অসহযোগিতায় তা পূর্ণতা পায়নি। সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি এসইসির নির্দেশনাকেও পাত্তা দেয়নি আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ।তথ্য দিতে অসহযোগিতার দায়ে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ রয়েছে এসইসির তদন্ত কমিটির। কিন্তু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি এনফোর্সমেন্ট বিভাগে না পাঠানোর নির্দেশনা দিয়ে তা ধামাচাপা দেন কমিশনের শীর্ষস্থানীয় ওই ব্যক্তি। উল্টো ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ থাকা আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজকে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ করে দিয়েছে এসইসি। এখন এসইসির ওই কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে শেয়ারে রূপান্তরযোগ্য এই বন্ডকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদে কারসাজির পরিকল্পনা করেছে কোম্পানিটি। অস্বাভাবিক মূল্যে বন্ডকে শেয়ারে রূপান্তরের অংশ হিসেবে কারসাজির মাধ্যমে শেয়ার দর অন্তত ছয় গুণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যাপক লুটপাটের আয়োজন চলছে। অন্যদিকে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নামে মূলধন বাড়ানোর মাধ্যমে কম দামে শত শত কোটি টাকার শেয়ার হাতিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, যাতে সায় দিতে যাচ্ছে এসইসি।এর আগে দুই দফায় রাইট শেয়ারের মাধ্যমে প্রায় ১৭৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করার সুযোগ করে দেওয়া হয় আলিফ গ্রুপের আলিফ ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিকে। এরপরও কোম্পানিটির আর্থিক স্বাস্থ্যে কোনো উন্নতি হয়নি। উল্টো আয় কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে রাইট শেয়ারের অর্থ ব্যবহার খতিয়ে দেখতে বিশেষ নিরীক্ষার জন্য নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হলেও কোম্পানিটি কোনো তথ্য না দেওয়ায় তা ভেস্তে যায়। এ ক্ষেত্রে এসইসি একাধিকবার নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার নির্দেশনা দিলেও তা আমলে নেয়নি আলিফ গ্রুপ। কমিশনের ওই কর্তার হস্তক্ষেপে নিরীক্ষা কাজও বন্ধ হয়ে যায়।তদন্তে অসহযোগিতা : কয়েক বছর ধরে সঠিক হিসাব বই ছাড়াই নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, যা বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারকে বিভ্রান্ত করছে। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন মিথ্যায় রূপ নিয়েছে, এমন অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর কমিশন সভায় আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ নিয়ে বিশেষ নিরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় এসইসি। অবশ্য, ২০২১ সালের ৩ মে বিশেষ নিরীক্ষার পরিবর্তে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৮ মে একটি কমিটি গঠন করা হয়।এসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী কোম্পানির নিরীক্ষিত প্রতিবেদন, প্রপার্টি প্ল্যান্ট অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট, কাঁচামাল, বিক্রি, অগ্রিম, বকেয়া, পাওনাদার, কোম্পানির পাঁচ বছরের ব্যাংক হিসাব বিবরণী, রপ্তানি ও ভ্যাট রিটার্নের তথ্য এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণও খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় তদন্ত কমিটি। এসব তথ্য চেয়ে কোম্পানিকে চিঠি পাঠায় কমিটি। কিন্তু তদন্ত কমিটিকে কিছু তথ্য দিলেও আর্থিক হিসাব সম্পর্কিত কোনো তথ্যই দেয়নি কোম্পানিটি। এমনকি তদন্ত কমিটি আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ পরিদর্শন করতে চাইলেও কোম্পানিটির অসহযোগিতায় তা সম্ভব হয়নি। এসইসি বাধ্য হয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের মেয়াদ বারবার বাড়িয়েছে।জালিয়াতির আর্থিক প্রতিবেদন : আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ হিসাব বছরে কোম্পানিটি নিট টার্নওভার দেখায় ২৮০ কোটি টাকা। এ সময় উৎপাদন ব্যয় দেখানো হয় ২৩৫ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটি বিক্রয় ও বাজারজাতকরণের ব্যয় দেখায় মাত্র ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু এই পাঁচ বছরে প্রশাসনিক খাতে কোম্পানির কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। ব্যাংক হিসাব থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে কোনো ব্যয় দেখাতে পারেনি।এসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দুই হিসাব বছরের বার্ষিক নিরীক্ষিত প্রতিবেদন ও অনিরীক্ষিত প্রান্তিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যে তৈরি। সঠিক হিসাব বই, প্রাথমিক রেকর্ড ও বৈধ দলিল ছাড়াই ওইসব প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।এমনকি আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবসা আলিফ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্বাধীন গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেডের নামে পরিচালিত হতো বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। এতে করে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হয়নি, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯-এর ১৮ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যেহেতু আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের নামে কোনো বিক্রি নেই, তাই ২০২১ সালের ৩০ জুন হিসাব বছরে বিক্রি থেকে ৫৫ কোটি টাকা আয়ের যে অঙ্ক উল্লেখ করা হয়েছে, তা মিথ্যা। এ সময়ে কোম্পানিটি ১৭ কোটি টাকার যে মজুদ পণ্য দেখিয়েছে, তাও মিথ্যা। পাঁচ বছরে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ নিট মুনাফা দেখিয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা, কিন্তু নগদ প্রবাহ মাত্র ৯৩ লাখ টাকা। নগদ প্রবাহ যা দেখানো হয়েছে, তাও মিথ্যা। কারণ কোম্পানির কোনো ব্যাংক হিসাবই নেই। গত চার বছরে কোম্পানিটি কোনো বিনিয়োগও করেনি। এমন আর্থিক চিত্র এটাই নির্দেশ করে যে, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ কার্যত চলমান কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়।শাস্তির সুপারিশ তদন্ত কমিটির : মিথ্যা ও বানোয়াট আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি, তদন্তে অসহযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি এসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগে পাঠানোর সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। কিন্তু কমিশনের প্রভাবশালী ওই ব্যক্তি এনফোর্সমেন্ট বিভাগে পাঠানোর নির্দেশনা দেননি।এরই মধ্যে এসইসির একাধিক নির্বাহী পরিচালকসহ কমিশনের ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির সঙ্গে সখ্যের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল অধিগ্রহণের সুযোগ পায় আলিফ গ্রুপ। এই অধিগ্রহণের মাধ্যমেই লুটপাটের নতুন নীলনকশা তৈরি করে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ। এমনকি প্রথা ভেঙে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের আংশিক উৎপাদনে ফেরার অনুষ্ঠানেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে উড়ে গিয়েছিলেন কমিশনের প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তা।বন্ডের মাধ্যমে কারসাজির পরিকল্পনা : দীর্ঘমেয়াদে অর্থ লুটপাটের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত বছরের ১০ নভেম্বর ৩০০ কোটি টাকার শেয়ারে রূপান্তরযোগ্য বন্ড ইস্যুর ঘোষণা দেয় আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ। বন্ডের অর্থে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল অধিগ্রহণ, ওই কোম্পানির ব্যাংক দায় পরিশোধ ও যন্ত্রপাতি কেনার কথা জানায় আলিফ ইন্ডাস্টিজ। কোম্পানিটিকে চলতি বছরের ২৬ মে শেয়ারে রূপান্তরিত বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দিতে প্রধান ভূমিকা রাখেন প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তা। ছয় বছর মেয়াদি বন্ডটি তৃতীয় বছর থেকে প্রতি বছর ২৫ শতাংশ করে শেয়ারে রূপান্তর হবে।শেয়ার কারসাজির পরিকল্পনায় বন্ডধারীদের আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের রূপান্তরিত শেয়ার সর্বোচ্চ ৩২৯ টাকায় কিনতে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশনকে বন্ড কেনায় প্রলুব্ধ করতে দেওয়া প্রস্তাবপত্রে রূপান্তরিত শেয়ারের এমন দরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কাল্পনিক মুনাফার লোভ দেখানো হয়েছে। কোম্পানির বর্তমান শেয়ার দর হচ্ছে ৫৩ টাকা ৪০ পয়সা। বন্ড বিক্রির প্রস্তাবে তৃতীয় বছরে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ৯ টাকা ১৪ পয়সা। আর ষষ্ঠ বছরে ইপিএস ১২ টাকা ৬৭ পয়সা হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।শুধু জীবন বীমা করপোরেশন নয় বন্ড কিনতে রাষ্ট্রায়ত্ত আরও দুটি ব্যাংককেও প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। উচ্চমূল্যে শেয়ারে রূপান্তরযোগ্য এই বন্ড কিনে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণের লোকসানের সম্মুখীন হতে পারে, এমন শঙ্কা আছে।বন্ড ইস্যুতে অযোগ্যতা : আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ড ইস্যুর সংশোধিত প্রস্তাব পর্যালোচনা করে এসইসি দেখতে পায় যে, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনে কোম্পানিটির নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক, যা ডেট সিকিউরিটিজ আইনে অযোগ্যতা। কোম্পানিটি কার্যক্রম চালুর পর থেকে প্রায়ই নগদ প্রবাহে ঋণাত্মক অবস্থা দেখা গেছে। এমনকি বন্ড শেয়ারে রূপান্তর হলে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিত শেয়ার ধারণের পরিমাণ ৩০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে। এটিও বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে অযোগ্যতা। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ডেট সিকিউরিটিজ) রুলস, ২০২১-এর ৪(৪) ধারা থেকে অব্যাহতি চেয়ে কমিশনে আবেদন জানায় কোম্পানিটি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ও এসইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার প্রভাবে কোম্পানির শেয়ার ধারণ ঠিক রাখতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার ইস্যু করে মূলধন বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হবে বলে এসইসির গত ২৬ এপ্রিলের কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট অনুযায়ী, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের দুজন পরিচালক ঋণখেলাপি থেকে মুক্ত। অপর পরিচালক মো. আজিমুল ইসলাম, মো. আজিজুল ইসলাম, লুবনা ইসলাম, লুৎফুন নেসা ইসলাম ও নাবিলা সালামের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণখেলাপি দেখানোর বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।সর্বশেষ তিন বছরের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের পণ্য বিক্রি ও পাওনা নিয়ে সন্দেহ, লভ্যাংশ্যে কর্মীর হিস্যায় নন-কমপ্লায়েন্স, বিলম্বিত কর দায় অতি মূল্যায়িত করার অভিযোগ ছাড়াও বিভিন্ন সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গের অভিমত রয়েছে। আর ২০২১ সালের ৩০ জুন হিসাব বছরে নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে নিরীক্ষক জানান যে, কোম্পানিটি সরাসরি রপ্তানিতে অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। রপ্তানি আয়ের বেশিরভাগই এসেছে সাব কন্ট্রাক্ট থেকে।২০১৯-২০ হিসাব বছর থেকেই কোম্পানির সরাসরি রপ্তানি আয় ধারাবাহিকভাবে কমতে দেখা গেছে। ২০২১ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানির রপ্তানি আয় ৩৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকায় নেমে আসে। একটি শতভাগ রপ্তানিমুখী কোম্পানি হিসেবে এটি যুক্তিসংগত নয় বলে মন্তব্য করে বন্ড প্রস্তাব যাচাই করে দেখার পরামর্শ দিয়েছে এসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ।আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারপ্রতি আয়ও (ইপিএস) ধারাবাহিকভাবে কমতে দেখা গেছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কোম্পানির ইপিএস ৪ টাকা ৩৭ পয়সা থেকে কমে ১ টাকা ৪৫ পয়সায় নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে এসইসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে মূলধন বৃদ্ধি বিভাগ।বন্ড ইস্যুর ঘোষণার পর ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকার মূলধন বাড়ানোর ঘোষণা দেয় আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ। এই শেয়ার মূলত উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নামে ইস্যু হবে। মূলধন বৃদ্ধির যৌক্তিকতা যাচাই করতে প্রতিষ্ঠানটির মূলধন ব্যয়ের খাত, পরবর্তী পাঁচ বছরের আর্থিক পরিস্থিতির পূর্বাভাস এবং কোম্পানির ঋণ সম্পর্কিত তথ্য চেয়ে পাঠায় এসইসি। অধিগ্রহণ করা কোম্পানির কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যাদি না পাওয়ায় এসইসিকে কোনো তথ্য দিতে পারেনি বলে জানায় আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ। এ অবস্থায় অধিগ্রহণ করা কোম্পানির ইকুইটি ও ঋণের পরিমাণ কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ।তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বন্ড ও নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ দিয়ে অধিগ্রহণ করা কোম্পানি সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ৩৬০ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ ও অন্যান্য দায় পরিশোধের কথা বলেছে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মধ্যে রয়েছে ৩৪৮ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ। কিন্তু আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ কোনো তথ্যাদি না দেওয়ায় সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ব্যাংকঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি। সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ওয়েবসাইটে কোনো আর্থিক তথ্য না থাকায় কোম্পানির স্টকের মূল্যায়ন, আর্থিক দায় এবং বন্ডের ব্যবহারের বিষয়টি পরিষ্কার নয়। এ ছাড়া বন্ডের চূড়ান্ত ব্যবহারকারী সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল হলেও কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি, এমনকি বন্ড ব্যবহারের বিস্তারিত পরিকল্পনাও জমা পড়েনি।এদিকে বন্ড শেয়ারে রূপান্তর হবে সর্বশেষ ২০ দিনের গড় মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে। কিন্তু উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নামে ইকুইটি শেয়ার ইস্যুর প্রস্তাব করা হয়েছে সর্বশেষ ১৮০ দিনের গড় মূল্যের ওপর ৪০ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে। ইকুইটি শেয়ারের ক্ষেত্রে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালকে বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ হিসাবে ওই সময়কালে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারের গড় মূল্য দাঁড়ায় ২৬ টাকা ৬৯ পয়সা। এ ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে নতুন ইস্যু করা শেয়ারের মূল্য হবে ১৭ টাকা ৮১ পয়সা। অথচ জীবন বীমা করপোরেশনকে দেওয়া বন্ড কেনার প্রস্তাবে দেখানো হয়েছে রূপান্তরিত শেয়ারের গড় মূল্য হবে ২৭৮ টাকা। নিজেদের নামে কম দামে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমেও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এ ছাড়া নতুন শেয়ার ইস্যুর ফলে কোম্পানির আর্থিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে কি না, তাও জানায়নি আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ।আলিফ ও এসইসির বক্তব্য : আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজিমুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বানানো তথ্যে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তদন্ত দল যেসব তথ্য চেয়েছে তার সবই দেওয়া হয়েছে। তদন্তের পর পুরোপুরি ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার পরই এসইসি আমাদের সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল অধিগ্রহণের অনুমোদন দিয়েছে। যদি কোনো অসংগতি থাকত তাহলে কোম্পানি অধিগ্রহণ কিংবা বন্ডের অনুমোদন এসইসির দেওয়ার কথা নয়।’রূপান্তরযোগ্য বন্ডের শেয়ার দর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জীবন বীমা করপোরেশন আমাদের কাছে শেয়ার দরের পূর্বাভাস চেয়েছিল। যেহেতু বন্ডের ব্যবহারে সুফল মিলবে, আয় ও মুনাফা বাড়বে এবং আমাদের পরিশোধিত মূলধনও কম। ইপিএস বাড়লে শেয়ার দরও বাড়বে। সেটাই তাদের জানানো হয়েছে।’ নতুন ইস্যু করা শেয়ার ও রূপান্তরিত বন্ডের শেয়ারের মূল্য নির্ধারণের সময় প্রসঙ্গে আজিমুল বলেন, উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নামে যে শেয়ার ইস্যু করা হবে, তা লক-ইন থাকবে। চাইলেই বিক্রি করা যাবে না। আর রূপান্তরিত শেয়ার দর নির্ধারণ হবে বাজার মূল্যের ভিত্তিতে।এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের কটন অ্যাসোসিয়েশন আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। যার কারণে কোম্পানিটি দুই বছর উৎপাদন করতে পারেনি। কিন্তু এ সময় অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রপ্তানি করেছে। পরবর্তীকালে সব কাগজপত্র ঠিক করে তারা বন্ডের আবেদন করলে তাতে অনুমোদন দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আলিফ গ্রুপ সাধারণত বন্ধ কোম্পানি কিনে সচল করে। তাদের এমন মনোভাবের কারণে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল অধিগ্রহণের আবেদনে কমিশন সম্মতি দিয়েছে। আর সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের দায় পরিশোধ ও উৎপাদন চালু রাখার জন্য যে বন্ডের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তা কিন্তু প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শুধু প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে হবে।’

Share this news