কেন নিরাপদ বিনিয়োগের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম

Date: 2023-04-15 17:00:35
কেন নিরাপদ বিনিয়োগের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল অনেকগুলো মাপকাঠি রয়েছে। তারমধ্যে ফান্ডামেন্টাল মাপকাঠি হলো মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও। যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শেয়ার ব্যবসায়ীরা সিংহভাগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তবে আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা অভিজ্ঞ ও সচেতন নয় বলে তারা শেয়ারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই গুঞ্জনের উপর ভর করে করেন। যার ফলে লাভের চেয়ে তারা ক্ষতির মুখেই বেশি পড়েন।পিই রেশিওর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী কয়েকটি নিয়ম অনুসরণ করা হয়। যেসব কোম্পানির পিই রেশিও ১০-এর নিচে সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকে ঝুঁকিবিহীন নিরাপদ বিনিয়োগ বলে মনে করা হয়। ১০-এর নিচে পিই রেশিও রয়েছে এবং ভালো ডিভিডেন্ড দেয়, এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করলে বাজারের যেকোন পরিস্থিতিতে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।এরপর পিই রেশিও ১৫ বা ২০-এর নিচে থাকা শেয়ারও বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ মনে করা হয়। তবে বিনিয়োগের আগে কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন, ডিভিডেন্ড ইতিহাস ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনাময় বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়।এদিকে, পিই রেশি ২০ থেকে ৪০ পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারও বিনিয়োগ উপযোগি বলে মনে করা হয়। যে কারণে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ৪০-এর নিচে পিইর শেয়ার মার্জিনেবল ঘোষণা করেছে। তবে এই পর্যায়ে বিনিয়োগের আগে কোম্পানিগুলোর মূলধন, ডিভিডেন্ড পরিস্থিতি, ব্যবসার সম্ভাবনা, শেয়ারের চাহিদা ও সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা।বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড মিলে ৪০৯টি সিকিউরিটিজ তালিকাভুক্ত রয়েছে। এরমধ্যে ব্যাংক খাতে রয়েছে ৩৫টি এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে ৩৬টি। যেগুলোর সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের পিই রেশিও ১০-এর নিচে। তবে বড় মূলধনী ব্যাংক এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দুর্বল পারফরমেন্সসহ নানা কারণে এই দুই খাতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম। যদিও ডিভিডেন্ড ঘোষণায় অন্যান্য খাতের চেয়ে এই দুই খাত বেশ এগিয়ে রয়েছে।বর্তমানে ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল খাত বাদে পিই রেশিও ১০-এর নিচে রয়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা রয়েছে মাত্র ১২টি। যেগুলোর শেয়ারদর খুবই নাজক। কয়েকটি শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের কিছু আগ্রহ থাকলেও বেশিরভাগ শেয়ারই তাদের অনাগ্রহের তালিকায় দেখা যায়। যে কারণে কোম্পানিগুলো ভালো ডিভিডেন্ড দিয়েও ফ্লোর প্রাইসের চৌহদ্দিতে আটকে আছে মাসের পর মাস। কোম্পানিগুলোর মধ্যে মুলধন, রিজার্ভ, ডিভিডেন্ড, ব্যবসায়িক সফলতাসহ বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে আছে এমন শেয়ারও বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহের তালিকায় দেখা যাচ্ছে।বর্তমানে যে ১২টি শেয়ারের পিই রেশিও ১০-এর নিচে সেগুলো হলো- জ্বালানি খাতের মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পিই রেশিও ৫.৯১, যমুন ওয়েলের ৫.৯৪ ও পদ্মা ওয়েলের ৬.৪৮, বিবিধ খাতের বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন-বিএসসির ৭.৬০ ও বেক্সিমকো ৭.৮৬; ফার্মা খাতের স্কয়ার ফার্মার ৮.৭৫ ও একমি ল্যাবের ৭.৮০; বস্ত্র খাতের হাওয়েল টেক্সটাইলের ৭.৮১, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল-পিটিএলের ৯.৬৭ ও মতিন স্পিনিংয়ের ১০ এবং বিমা খাতের গ্রীণডেল্টা ইন্সুরেন্সের ৮.৯২ ও রিলায়েন্স ইন্সুরেন্সের ৯.৪৫।কোম্পানিগুলোর মধ্যে দুই-তিনটি ছাড়া বাকি সবগুলো কোম্পানিই শেয়ারবাজারে শীর্ষ ডিভিডেন্ড দেয়ার কোম্পানি। ব্যবসার সম্ভাবনাও খুব ভালো। আর্থিক প্রতিবেদনও বেশ স্বচ্ছ। তারপরও কেন যে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তেমন নেই, এর কোনো যুক্তিসংগত কারণ পাওয়া যায়নি। তবে কোম্পানিগুলোর মালিকরা কারসাজির সঙ্গে জড়িত নন বলেই হয়তো শেয়ারগুলোর দরে ঝলক দেখা যায় না। এখনতো শেয়ারবাজারে সিংহভাগ কোম্পানির মালিকরা নিজেরাই তাদের শেয়ার নিয়ে মাতামাতি করেন। যে কারণে ইচ্ছেমতো আর্থিক প্রতিবেদন বাড়ান-কমান, ইচ্ছেমতো ডিভিডেন্ড বাড়ান-কমান, ইচ্ছেমতো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য তৈরি করেন, যে কারণে শেয়ার দরে দেখা যায় বড় উত্থান ও পতন।ডিভিডেন্ড: কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল-পিটিএল ১০ শতাংশ ক্যাশ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন-বিএসসি ২২ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে, হাওয়েল টেক্সটাইল ২৫ শতাংশ ক্যাশ, রিলায়েন্স ইন্সুরেন্স ২৫ শতাংশ ক্যাশ, বেক্সিমকো ৩০ শতাংশ ক্যাশ, একমি ল্যাবরেটরিজ ৩০ শতাংশ ক্যাশ, গ্রীণডেল্টা ইন্সুরেন্স ৩০ শতাংশ ক্যাশ, মতিন স্পিনিং ৫০ শতাংশ ক্যাশ, স্কয়ার ফার্মা ১০০ শতাংশ ক্যাশ, যমুন ওয়েল ১২০ শতাংশ ক্যাশ, পদ্মা ওয়েল ১২৫ শতাংশ ক্যাশ এবং মেঘনা পেট্রোলিয়াম ১৫০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে।মূলধন: পিই রেশিও কম থাকা এই ১২ কোম্পানির মধ্যে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পরিশোধিত মূলধন ১০৮ কোটি ২১ লাখ, যমুনা ওয়েলের ১১০ কোটি ৪২ লাখ ও পদ্মা ওয়েলের ৯৮ কোটি ২৩ লাখ, বিবিধ খাতের বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন-বিএসসির ১৫২ কোটি ৫৩ লাখ ও বেক্সিমকো ৮৯৫ কোটি ৯৪ লাখ, ফার্মা খাতের স্কয়ার ফার্মার ৮৮৬ কোটি ৪৫ লাখ ও একমি ল্যাবের ২১১ কোটি ৬০ লাখ; বস্ত্র খাতের হাওয়েল টেক্সটাইলের ৫৬ কোটি, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল-পিটিএলের ১৬২ কোটি ৮৩ লাখ ও মতিন স্পিনিংয়ের ৯৭ কোটি ৪৯ লাখ এবং বিমা খাতের গ্রীণডেল্টা ইন্সুরেন্সের ১০০ কোটি ১৮ লাখ ও রিলায়েন্স ইন্সুরেন্সের ১০৫ কোটি ১৬ লাখ।রিজার্ভ: এই ১২ কোম্পানির মধ্যে যমুন ওয়েলের রিজার্ভ ১৯৪০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ১৭ গুণ, পদ্মা ওয়েলের ১৬৮১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ১৭ গুণ, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ১৭৭৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ১৬ গুণ, স্কয়ার ফার্মার ৯২৫৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের সাড়ে ১০ গুণ, বেক্সিমকো ৬৯৩১ কোটি ২১ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ৭.৭৩ গুণ, একমি ল্যাবের ১৪৪৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ৬.৮২ গুণ, গ্রীণডেল্টা ইন্সুরেন্সের ৫৯৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের প্রায় ছয় গুণ, রিলায়েন্স ইন্সুরেন্সের ৬০৭ কোটি ০২ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ৫.৭৭ গুণ, মতিন স্পিনিংয়ের ৪০১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ৪.১১ গুণ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন-বিএসসির ৪৮৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ৩ গুণ, হাওয়েল টেক্সটাইলের ১৩৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের আড়াই গুণ এবং প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল-পিটিএলের ২৬৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মূলধনের ১.৬৫ গুণ।প্রবৃদ্ধিতে কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিএসসি, মতিন টেক্সটাইল ও স্কয়ার ফার্মা মুনাফা ও ডিভিডেন্ডের দিক থেকে গত দুই বছর যাবত ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে।

Share this news