জেনেক্স ইনফোসিসে আবারও সেই চক্রের হানা!

Date: 2022-11-05 01:00:10
জেনেক্স ইনফোসিসে আবারও সেই চক্রের হানা!
প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। তারপর লোভনীয় মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্দ করা হয়। এরপর চড়া দামে সেই শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে চাপানো হয়।এরপর শেয়ারের দাম ধীরে ধীরে আবার তলানিতে আনা হয়। তারপর কম দামে সেই শেয়ার সংগ্রহ করা হয়। এক পর্যায়ে শেয়ার যখন সংগ্রহ শেষ হয়, তখন শুরু হয় দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া। কয়েকদিনের মধ্যে দাম তোলা হয় পরিকল্পিত পর্যায়ে। তারপর পর আবারও লোভনীয় মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। করা হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্দ। তারা লাভের আশায় ঝাপিয়ে পড়েন শেয়ারটিতে। তারপর অতি লোভে তাতি নষ্ট। ফের লোকসানের ফাঁদে।শেয়ারটির নাম জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড। বছরজুড়ে কারসাজির এক শেয়ারের নাম। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ও শেয়ারবাজারের আলোচিত শেয়ার কারসাজিকারি এক সরকারী কর্মকর্তার যোগসাজসে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ফকির করার এক মেগা প্রকল্পের নাম। বছরজুড়েই দেখানো হয় চমক দেখানো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। কিন্তু বছরশেষে ‘যে লাউ সেই কদু’। ডিভিডেন্ডও বাড়ে না, মুনাফায়ও চমক থাকে না। বরং বছরশেষে দেখা যায় ডিভিডেন্ডে পতন। বাড়ি পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাথায়। আর হাসি ফোটে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ও কারসাজিকারির মুখে। কারণ কারসাজির নতুন প্লট করা যাবে নতুন আঙ্গিকে, নতুন উদ্যোমে।জেনেক্স ইনফোসিস গত এক বছরে একের পর এক চুক্তির খবর বাজারে ছড়িয়ে শেয়ারদর বৃদ্ধি করেছে ১৭৭ টাকা পর্যন্ত। এরপর থেকে কোম্পানিটির শেয়ারদর কমতে কমতে অবস্থান নেয় ৬৮ টাকায়। অর্থাৎ মাত্র আট মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর কমেছে ১১১ টাকা বা ৬৩ শতাংশ। এর আগে মে’২১ কোম্পানিটির শেয়ারদর ৫৪ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ১৭৭ টাকায়। এখন আবারও সেই একই চক্র এই শেয়ারে হানা দিয়েছে বলে মনে করছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ঠরা।প্রথম দফা কারসাজিবিএসইসি যখন প্রথম শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে, তখন কোম্পানিটির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস ছিল ৫৪ টাকা ৭০ পয়সা। ২০২১ সালের মে পর্যন্ত দীর্ঘদিন শেয়ারটি ফ্লোর প্রাইসে ক্রেতাহীন অবস্থায় আটকে ছিল। তারপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রফাদফা হয় সমবায় অধিদপ্তরের আলোচিত সেই কারসাজির। শুরু হয় নতুন নতুন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন প্রচার।২০২১ সালে ০৯ মে কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি’র সঙ্গে ‘ইআরপি মাস্টার সার্ভিস এগ্রিমেন্ট’চুক্তির প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন। চুক্তিটির ফলে কোম্পানিটির ২২ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হবে বলে জেনেক্স ইনফোসিস বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্দ করা হয়। এরফলে কোম্পানিটির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইস ভেঙ্গে ৯১ টাকার ওপরে উঠে যায়। তখনই ২৭ মে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের নতুন একটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করার কথা জানায়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লাভের আশায় কোম্পানিটির শেয়ারে ঝাপিয়ে পড়ে। আর কারসাজিকারিরা অনায়াশে শেয়ারটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে চাপায়। তারপর শেয়ারটির দর সংশোধন হয়ে ৮০ টাকায় নেমে আসে।দ্বিতীয় দফা কারসাজিশেয়ারটি ৮০ টাকায় নেমে আসার পর বেশ কিছুদিন একই জায়গায় ঘুরাফিরা করে। এই পর্যায়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে শেয়ারটি ছেড়ে দিতে থাকে। আর কারসাজিকারিরা শেয়ারটি সংগ্রহ করতে থাকে। সংগ্রহ করার পর প্রায় দেড় মাসের মাথায় শেয়ারটির দামে আবারও চাঙ্গাভাব দেখা যায়। কয়েকদিনের মধ্যে শেয়ারটির দাম ১২০ টাকার ওপরে তোলা হয়। এই সময়ে ইডকো বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে সিকিউরিটি সলিউশন সংক্রান্ত একটি চুক্তির খবর প্রচার করা হয়। চুক্তিটির ফলে কোম্পানিটির ২৪ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে বলে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জানায়।রপর দুই মাসের মাথায় ০৫ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটি লজিস্টিক লিমিটেড নামক একটি কোম্পানিতে ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ করার খবর প্রকাশ করে। এতে কোম্পানিটির প্রতিবছর ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হবে বলে জানায়।৩য় দফা কারসাজিগত ২৮ জুলাই শেয়ারবাজারে ফের ফ্লোর প্রাইস আরোপ করার পর কোম্পানিটির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারিত হয় ৬৮ টাকায়। ফ্লোর প্রাইসে শেয়ারটি অনেক দিন আটকে থাকে। এরপর ভালো ডিভিডেন্ডের গুঞ্জন ছড়িয়ে শেয়ারটির দর ৮৫ টাকায় তোলা হয়। এই পর্যায়ে শেয়ার বিক্রি করে হতাশ করা লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়। ফলে শেয়ারটির দর ফের ৬৮ টাকা ফ্লোর প্রাইসে এসে গড়াগড়ি খেতে থাকে। তারপর বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে কোম্পানিটির শেয়ার ছেড়ে দেয়।চতুর্থ দফা কারসাজিশেয়ারটির দর যখন ফের ফ্লোর প্রাইসে ফিরে আসে, তখন শেয়ারটির কারসাজিকারিরা ফের তুলে নিতে থাকে। শেয়ারটি তোলা যখন সম্পন্ন হয়, আবারও টানা শেয়ারটির দর উঠাতে থাকে। ৬৮ টাকা থেকে ৯১ টাকার ওপরে উঠানোর পর গত বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে কোম্পানিটির বিশাল ব্যবসসার প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন আসে। এবার কোম্পানিটি জানায়, এনবিআর এর সঙ্গে কোম্পানিটির ১০ বছরের একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এতে ১০ বছরে কোম্পানিটির আয় হবে ২ হাজার ১২০ কোটি টাকা।চড়া দরে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি২৩ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে জেনেক্স ইনফোসিস বাংলাদেশ এলএনজি এন্ড পাওয়ার লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন একটি চুক্তির কথা জানায়। এই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৭৬ টাকার ওপরে অবস্থান করে। যা কোম্পানিটি তালিকাভুক্তির পর সর্বোচ্চ দর। তখন ২৫ নভেম্বর ২০২১ তারিখে কোম্পানির এক পরিচালক চৌধুরী ফজলে ইমাম তার স্ত্রী নিলুফার ইমামকে কোম্পানিটির ২৫ লাখ শেয়ার গিফট করার কথা জানান। একইদিন আরেক পরিচালক গুপ্ত সাহা তার মাকে ৩ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার গিফট করার কথা জানান। যে শেয়ারগুলো হস্তান্তরের পর চড়া দরে বাজারে বিক্রি করা হয়। যেগুলো প্রকারান্তরে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই ভবিষ্যত লাভের আশায় কিনেন। এই সময়ে যারা চড়া দরে কোম্পানিটির শেয়ার কিনেন, তাদের এখনো রক্তক্ষরণ চলছে।জেনেক্স ইনফোসিসের লভ্যাংশ২০২১ সালের মে মাস থেকে কোম্পানিটি অন্তত ৫টি প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশেন প্রকাশ করেছে। এতে বিনিয়োগকারীরা অনেক আশাবাদী ছিলেন, এবছর ২০২২ সালে কোম্পানিটি তাদের আরেও ভালো ডিভিডেন্ডের মুখ দেখাবে। কিন্তু তাদের সেই আশায় গুড়েবালি। ২০২১ সালে কোম্পানিটি যেখানে ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। যার মধ্যে ছিল ১০ শতাংশ ক্যাশ ও ১০ শতাংশ বোনাস। এবার ডিভিডেন্ড দিয়েছে ১১ শতাংশ ক্যাশ এবং ২ শতাংশ স্টক। তাও আবার কেবল সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য। উদ্যোক্তা পরিচালকরা এবার ডিভিডেন্ড নিবেন না। কারণ তারাতো এমনিতে শেয়ারটি থেকে সময়ে সময়ে সোনার ডিম আহরণ করছেন।কোম্পানিটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসে ছিলো ৬৮ টাকায়। এই দর থেকে আবারও কোম্পানিটির শেয়ার বেড়েই চলেছে। শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে নেই কোন কারণ। তবে কারসাজি চক্রের সাথে আগের মত হাত মিলিয়ে কোম্পানিটি নতুন চুক্তির খবর দিয়ে আবারও শেয়ারটিকে টেনে উঠানোর পায়তারা করছে কি না তা ক্ষতিয়ে দেখার দাবি করছে বিনিয়োগকারীরা।গত ২৩ অক্টোবর কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিলো ৬৮ টাকায়। মাত্র চার কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১ টাকা ১০ পয়সায়। চার দিনে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২৩ টাকা ১০ পয়সা বা ৩৪ শতাংশ। সর্বশেষ ক্লোজিং প্রাইস দাঁড়িয়েছে ৮৭ টাকা ৪০ পয়সায়।এর আগে, কোম্পানিটিকে পাযালোচনা করে দেখা গেছে, একর পর এক চুক্তির খবর দিয়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিটি চুক্তিতে কোম্পানিটির মুনাফা কয়েক কোটি টাকা হবে বলে তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য আগের বছরের চেয়ে ডিভিডেন্ড কমেছে ৭ শতাংশ।অথচ কোম্পানিটির গেলো বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর’২১) শেয়ার প্রতি আয় দেখিয়েছে ১ টাকা ৩৩ পয়সা। আর (জুলাই-ডিসেম্বর’২১) ছয় মাসে আয় দেখিয়েছে ২ টাকা ৭৪ পয়সা। আর তৃতীয় প্রান্তিকে ((অক্টোবর’২১-মার্চ’২২) আয় দেখিয়েছে ৩ টাকা ২৬ পয়সা, আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ২ টাকা ৭৯ পয়সা। অর্থাৎ (জানুয়ারি-মার্চ’২২) ইপিএস হয়েছে ৬৯ পয়সা। আর বছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ টাকা ৩৬ পয়সায়। অর্থাৎ শেষের তিন মাস কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় বেড়ে হয়েছে ১০ পয়সা।কোম্পানিটির সবচেয়ে বেশি মুনাফা দেখিয়েছে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১ টাকা ৩৩ পয়সা। আর সে সময়েই কোম্পানিটর যতসব চুক্তির ঘোষণা আসে। চুক্তির সাথে সাথে কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়তে থাকে। কারণ বিনিয়োগকারীরা ভেবেছে কোম্পানিটির নতুন চুক্তির কারণে ইপিএস আরও বেড়ে যাবে। আর ইপিএস বাড়লে কোম্পানিটি বিনিয়োগকালীদের জন্য ভালো ডিভিডেন্ড দিতে পারবে। কিন্তু বছর শেষে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণ করেছে বলে মনে করছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।গত বছর কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৭৭ টাকা উঠার পর থেকে কারসাজি চক্র শেয়ার বিক্রি শুরু করেছে। আর শেয়ার বিক্রির সাথে সাথে কোম্পানিটির ইপিএসও কমতে শুরু করেছে। আর এই সময়ে পথে বসেছে হাজারো সাধারণ বিনিয়োগকারী। এখন সেই একই চক্র আবারও কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি শুরু করেছে। কোন কারন ছাড়াই বাড়তে শুরু করেছে কোম্পানিটির শেয়ারদর।একের পর কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা হলেও কারসাজি চক্র বা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যার কারণে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করে পথের পকির হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। বিএসইসির এমন নিরবতা বিনিয়োগকারীদের সর্বশান্ত করছে। এখন এই কারসাজি চক্রর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি ক্ষতির মূখে পারবে বলে মনে করছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।এ বিষয়ে কোম্পানি সচিব জুয়েল রাশেদ সরকার বলেন, সর্বশেষ ৩০ জুন ২০২২ অর্থবছরে কোম্পানিটি আগের বছরের তুলোনায় ৭ শতাংশ কম ডিভিডেন্ড দিয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের পাশাপাশি তিন বছর পর শেয়ারের লক ফ্রি এবং গত বছরের স্টক ডিভিডেন্ড বাজারে আসার কারেণে কোম্পানিটির শেয়ারদরে প্রভাব পরেছে। যার কারণে কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৭৭ টাকা থেকে কমে ৬৬ টাকায় এসেছে।তবে কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি তিনি।

Share this news