ইউনাইটেড কি ডানা মেলবে না

Date: 2023-09-22 17:00:11
ইউনাইটেড কি ডানা মেলবে না
বন্ধ হয়ে যাওয়া বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ ব্যর্থ হতে চলেছে। বিমান সংস্থাটির কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বা বেবিচক ও সরকারের পাওনা অর্থ মওকুফের আবেদন বাতিল হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ কারণে ইউনাইটেড এয়ারের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) আবেদন করেছে। গত জুনে এ আবেদন করা হয়।জানা গেছে, ইউনাইটেড এয়ারের পুনর্গঠিত পর্ষদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির আবেদনটি গ্রহণ করা হলে প্রতিষ্ঠানটিকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগটি পুরোপুরি ভেস্তে যাবে। তাই এখনো পর্ষদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএসইসি।২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউনাইটেড এয়ারের পর্ষদ পুনর্গঠন করে বিএসইসি। গঠিত হয় সাত সদস্যের নতুন পরিচালনা পর্ষদ। তাতে কোম্পানিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান এভিয়েশন–বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম। পুনর্গঠিত পর্ষদ কোম্পানিটির পাঁচ আর্থিক বছরের আর্থিক হিসাবনিকাশ নিরীক্ষার পাশাপাশি আট বছরের স্থগিত বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএমও সম্পন্ন করে। সেই সঙ্গে ইউনাইটেড এয়ারের অব্যবহৃত উড়োজাহাজ ও মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যবহার উপযোগিতার বিষয়ে কারিগরি নিরীক্ষাও করানো হয়। পাশাপাশি নতুন করে এ বিমান সংস্থাটি চালু করতে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঋণ ও বিনিয়োগ নিয়ে কথাবার্তাও চূড়ান্ত করেছিল পুনর্গঠিত পর্ষদ।বন্ধ প্রতিষ্ঠানটির উড়োজাহাজ আবার আকাশে ওড়াতে ব্যবসায়িক পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করে কোম্পানিটি। তবে দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা উড়োজাহাজ দিয়ে উড্ডয়ন পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। তাই পুরোনো উড়োজাহাজগুলো বিক্রি করে দিয়ে নতুন উড়োজাহাজ ভাড়ায় এনে এটির কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেয় নতুন পর্ষদ; কিন্তু সেটিও এখন সম্ভব হচ্ছে না।ইউনাইটেডের কাছে পাওনা কতবিএসইসি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনাইটেড এয়ারের কাছে বেবিচকসহ সরকারের পাওনার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেবিচকের মূল পাওনা ৫৬ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ভ্যাট, আয়কর ও সারচার্জ বাবদ পাওনা। ব্যাংকঋণ ও অন্য দেশের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছেও কয়েক শ কোটি টাকার বকেয়া রয়েছে।নতুন করে কার্যক্রম শুরুর জন্য শুরুতে সরকারের পাওনা মওকুফের জন্য ইউনাইটেড এয়ারের পুনর্গঠিত পর্ষদ বিএসইসির মাধ্যমে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। পরে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে চায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় এই পাওনা মওকুফে অসম্মতি জ্ঞাপন করে।ইউনাইটেড এয়ারের পুনর্গঠিত পর্ষদের একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে জানান, বেবিচক ও সরকারের পাওনা মওকুফ করা না হলে বন্ধ কোম্পানিটিকে সচল করা সম্ভব হবে না।ইউনাইটেড এয়ারের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারিগরি নিরীক্ষার মাধ্যমে আমরা দেখেছি, প্রতিষ্ঠানটির যেসব উড়োজাহাজ ও সম্পদ রয়েছে, তা বিক্রি করে ৪০ লাখ ডলারের মতো পাওয়া যাবে। সেই অর্থে নতুন উড়োজাহাজ এনে প্রতিষ্ঠানটিকে আবারও উড্ডয়নে ফেরানো সম্ভব। এ জন্য আমরা একাধিক বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তারাও বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।’বিএসইসি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইউনাইটেডের নিজস্ব ১০টি উড়োজাহাজ দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে আটটি উড়োজাহাজ রয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। একটি রয়েছে ভারতের রায়পুর বিমানবন্দরে, অন্যটি পাকিস্তানের করাচি বিমানবন্দরে। সূত্রটি বলছে, এসব উড়োজাহাজ ব্যবহার উপযোগিতা হারালেও এগুলোর যন্ত্রাংশসহ মূল্যবান অনেক কিছুই বিক্রি করা যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব সামগ্রীর চাহিদাও রয়েছে।এ বিষয়ে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, ‘ইউনাইটেডের কাছে যে বকেয়া পাওনা ছিল, তা সরকারের পাওনা। এ পাওনা মওকুফের এখতিয়ার আমাদের নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ই এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। পাওনা মওকুফের আবেদন অর্থ মন্ত্রণালয় নাকচ করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কিছু নেই।’মফিদুর রহমান আরও বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে ইউনাইটেডের পুরোনো উড়োজাহাজ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়ার সুযোগ আমাদের পক্ষে ছিল না। তাই আমরা তাদের জানিয়েছিলাম, নতুন উড়োজাহাজ এনে যদি তারা সেটি চালু করতে চায়, সে ক্ষেত্রে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। পাশাপাশি অতীতের মতো যাতে ভবিষ্যতে কোম্পানিটি গায়েব হয়ে না যায়, সেই নিশ্চয়তাও চেয়েছি আমরা। এখন সরকারের কাছ থেকে তারা পাওনা মওকুফ করিয়ে এনে ও আমাদের শর্ত পরিপালন করে কার্যক্রম চালাতে চায়, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’আবারও অনিশ্চয়তায় দেড় লাখ বিনিয়োগকারীইউনাইটেড এয়ার বর্তমানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) মার্কেটে তালিকাভুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ২০২১ সালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কোম্পানিটিকে ওটিসি বাজারে স্থানান্তর করে।২০১০ সালে এটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার বিনিয়োগকারীর। ২০১৫ সালের পর কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বর ওটিসি মার্কেটে কোম্পানিটির কিছু শেয়ারের লেনদেন হয়। প্রতিটি শেয়ারের সর্বশেষ বাজারমূল্য ছিল ১ টাকা ৮০ পয়সা।ইউনাইটেড এয়ারের শেয়ারের সিংহভাগেরই মালিকানা ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠানের হাতে। কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে আছে মাত্র আড়াই শতাংশ শেয়ার।অথচ আইন অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে সব সময় ওই কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। আর পরিচালকদের হাতে এককভাবে সব সময় ২ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে; কিন্তু কোম্পানিটির উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা এ আইন লঙ্ঘন করে তাঁদের হাতে থাকা সব শেয়ার গোপনে বাজারে বিক্রি করে দেন।এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে কোম্পানিটিকে চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল বিএসইসি; কিন্তু সেই উদ্যোগও এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। ফলে পর্ষদ পুনর্গঠনের উদ্যোগে কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আশা তৈরি হয়েছিল, তা আবার অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

Share this news