ইনফরমেশন সার্ভিসেসের শেয়ারে থেমে নেই কারসাজি!

Date: 2022-09-25 23:00:18
ইনফরমেশন সার্ভিসেসের শেয়ারে থেমে নেই কারসাজি!
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইটি খাতের কোম্পানি ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক লিমিটেডের ২০২১ হিসাববছরে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে প্রায় ৯ টাকা এবং কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি প্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন টাকা। তবে এ ৯ টাকা লোকসান ও তিন টাকা এনএভি নিয়েই কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েই চলেছে। এতে কোম্পানিটির শেয়ারদর এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে দাঁড়ায় ৬০ টাকার বেশি। কোম্পানিটির ব্যবসা খারাপ অবস্থায় থাকার পরও শেয়ারদরে এই উত্থানের কারণ হিসেবে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন কম এবং লভ্যাংশ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে একটি চক্র কারসাজির মাধ্যমে বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। সেইসঙ্গে কোম্পাটির শেয়ারদরের এই কারসাজি দেখেও ডিএসই ও বিএসইসি চুপ থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা।কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালের লোকসানের পর কিছুটা উত্থানে ফিরলেও কোম্পানটির ব্যবসা গত চার বছরে ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। এতে গত হিসাববছরে কোম্পানির বড় লোকসান হয়। গত হিসাববছরে কোম্পানিটির ব্যবসায় লোকসান হয়েছে ৯ কোটি ২২ লাখ ৯০ হাজার টাকা, যা শেয়ারপ্রতি ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। এছাড়া কোম্পানিটির এনএভি ছিল ২ টাকা ৪৭ পয়সা, যে কারণে গত বছর কোম্পানিটি কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি।এদিকে চলতি ২০২২ হিসাববছরে কোম্পানিটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরের প্রথম ৯ মাসে কোম্পানটির ইপিএস হয়েছে ৪৩ পয়সা এবং এনএভি হয়েছে ২ টাকা ৯০ পয়সা। সে হিসাবে কোম্পানটি চলতি হিসাববছরে এখন পর্যন্ত গত বছরের লোকসান কাটিয়ে কিছুটা মুনাফা করেছে। তবে গত ৩০ জুন সমাপ্ত হওয়া হিসাববছরের আর্থিক প্রতিবেদন কোম্পানিটি প্রকাশ করেনি। তাই বছর শেষে কোম্পানটির মুনাফা কত হয়েছে বা লোকসান হয়েছে কি না, তা জানা নিয়ে এখনও অপেক্ষা করছে বিনিয়োগকারীরা।অপরদিকে কোম্পানটি যদি চলতি হিসাববছরের আগের প্রান্তিকের ধারাবাহিকতায় মুনাফাও করে তাহলে খুব বেশি লভ্যাংশ আশা করছে না অনেকেই। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, কোম্পানটির ইপিএস যদি তৃতীয় প্রান্তিক অনুসারে ১৭ পয়সা বা সর্বোচ্চ ২০ পয়সাও হয়, তাহলে বছর শেষে কোম্পানিটির মোট ইপিএস দাঁড়াবে ৬০ বা ৬৩ পয়সা। সে হিসাবে কোম্পানিটির লভ্যাংশ পাঁচ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ কোম্পানিটির আগের গত ১০ বছরের লভ্যাংশ দেয়ার তথ্যে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে কোম্পানিটি পাঁচ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দেয়নি। এরমধ্যে ২০১১ ও ২০১২ সালে পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশই ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ। এরপর ২০১৯ ও ২০২০ সালে কোম্পানিটি যথাক্রমে ২ ও ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। অথচ কোম্পানিটির ইপিএস গত ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে ছিল ৪৮, ৪০ ও ১৮ পয়সা ছিল। সেদিক থেকে কোম্পানিটি ২০১৮ সালে ৪৮ পয়সা ইপিএস নিয়েও কোনো লভ্যাংশ দেয়নি এবং ২০১৯ সালে ৪০ পয়সা ইপিএসের বিপরীতে দিয়েছে মাত্র দুই শতাংশ নগদ লভ্যাংশ। কোম্পানিটির এই লভ্যাংশ দেয়ায় অনেকে বলছেন, কোম্পানিটি চলতি হিসাববছরে মুনাফা হলেও আবার লভ্যাংশ নাও দিতে পারে। কারণ কোম্পানিটি এখনও রিজার্ভ এবং সারপ্লাস সাত কোটি ৮৬ লাখ টাকা ঋণাত্মক রয়েছে। সেই ঘাটতি পূরণের জন্যও কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণা না দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।এদিকে কোম্পানিটির শেয়ারদর ও লেনদেনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারদর গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৪৬ টাকা ৭০ পয়সা। এরপর কোম্পানির আর্থিক অবস্থার অবনতি এবং লোকসানের ফলে দর কমতে থাকে। এতে নভেম্বরে এসে শেয়ারদর দাঁড়ায় ৩৩ টাকা ২০ পয়সায়। এরপর শেয়ারদর আবার বাড়তে থাকে এবং ডিসেম্বরে শেয়ারটির দর হয় ৪৮ টাকা ৮০ পয়সা। পরে কোম্পানিটির শেয়ারদর কমতে থাকে এবং চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে আবার শেয়ারটির দর বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। সেই বৃদ্ধি পাওয়ার ধারাবাহিকতায় শেয়ারটির দর গত জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ৬৩ টাকা দাঁড়ায়। এরপর কোম্পানিটির শেয়ারের দর উত্থান ও পতনের মধ্যে থাকে।বিশ্লেষণে গত নভেম্বরের তুলনায় শেয়ারটির দর জুলাইতে বেড়েছে ২৯ টাকা ৮০ পয়সা বা ৮৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া গত এপ্রিল মাসে শেয়রটির সর্বনি¤œ দর ছিল ৪২ টাকা, সে হিসাবে জুলাই মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২১ টাকা বা ৫০ শতাংশ।অপরদিকে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেনে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন মাসে শেয়ারটির সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। জুনের ২২ তারিখ কোম্পানিটির শেয়ার সর্বোচ্চ ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৯৮২টি লেনদেন হয়, যা কিনা এক বছরের মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চ লেনদেন এবং সেদিন কোম্পানিটির শেয়ারদর এক বছরের মধ্যে প্রথম সর্বোচ্চ হয়ে ৫৩ টাকা ১০ পয়সা হয়েছে। এরপর আবার জুলাই মাসের ১৪ তারিখ কোম্পানিটির শেয়ার ৯ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৯টি লেনদেন হয়, যার মাধ্যমে কোম্পানিটির শেয়ারদর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়ে ৬৩ টাকায় পৌঁছে। এরপর কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন কমতে ও বাড়তে থাকে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পুঁজিবাজারে স্বল্প মূলধনি পরিশোধিত (লো পেইড আপ কোম্পানি) কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয়ে থাকে সব সময়। এ কারসাজিতে মুনাফা শুধু কারসাজিকারীদেরই হয়ে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এবং যাদের মধ্যে কারসাজির শেষ সময় শেয়ার ক্রয় করে, তারা সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইনফরমেশন সার্ভিসেস সেই লো পেইড আপ ক্যাটেগরির একটি কোম্পানি। কোম্পানিটির ব্যবসায় উন্নতি নেই, আছে অবনতির ধারাবাহিকতা। এরপরও কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েই চলে। একটি তিন টাকা এনএভির কোম্পানির শেয়ারদর কীভাবে ৬৩ টাকা হয়Ñএমন প্রশ্ন তুলে তারা বলেন, কোম্পানির শেয়ারদর সর্বোচ্চ ফেস ভ্যালুতে থাকাই তো যথেষ্ট। যেখানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১০ কোটি ৯২ লাখ টাকা আর অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা, সেখানে কোম্পানিটির শেয়ারের ফেস ভ্যালু অনুযায়ী ১০ টাকাও এনএভি নেই। সেই শেয়ারের দর হয় ৬৩ টাকা আর এখন ৫০ টাকার ওপরে। এখানে নিশ্চিত করেই কারসাজি চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।তারা বলছেন, কোম্পানিটির হিসাববছর শেষ হয়েছে জুন মাসে। সে হিসাবে কোম্পানিটির লভ্যাংশ ঘোষণা বা বছর শেষের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। সেই বিষয়টিকে পুঁজি করেই কারসাজি চক্র শেয়ারটির দর বাড়িয়ে চলেছে বলে জানান তারা। এর আগেও একবার এ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার কারণে কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে। তারপরও সেই কারসাজি থেমে নেই, কারণ বিএসইসি কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।এ বিষয়ে ডিএসই ও বিএসইসি নিশ্চুপ জানিয়ে তারা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়ার কারণে গত এক বছরেও কোম্পানিটির কাছে ডিএসই কোনো ব্যাখ্যা চায়নি। অথচ একটি কোম্পানি কিছুদিন বাড়লেই এবং অতি মূল্যায়িত ও অস্বাভাবিক দর হলে ডিএসইর কোম্পানিটির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার কথা। অথচ যেখানে কোম্পানিটির লভ্যাংশ বা হিসাববছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের সময় অস্বাভাবিক দর হয়েছে, সেখানে ডিএসই চুপ হয়ে আছে। একইভাবে বিএসইসি ডিএসইর প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে কিছুই বলছে না। যেখানে এর আগে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার কারণে কয়েকজনকে জরিমানা করা হলো সেখানে ৬৩ টাকা হওয়ার পরও বিএসইসিও চুপ করে আছে। তাহলে কি ডিএসই ও বিএসইসি এ কারসাজির সুযোগ করে দিচ্ছে নাÑএমন প্রশ্ন করে তারা বলেন, এসব কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধির পরও যেখানে ডিএসই ও বিএসইসি চুপ করে থাকে, সেখানে বাজারে বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতেই থাকবে।এ বিষয়ে কোম্পানির সচিব ফকরুল ইসলাম ভুঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, পুঁজিবাজার একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার। এখানে প্রতিযোগিতার ফলে শেয়ারদর বাড়বে এবং কমবে এটাই স্বাভাবিক। তবে কোম্পানির শেয়ারদর কেন এত বেড়েছে, সে বিষয়ে আমার জানা নেই।মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশকে কেন্দ্র করে এ দর বাড়ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ডিএসই জানতে চাইতে পারে। কিন্তু ডিএসই থেকে এখনও কিছু জানতে চাওয়া হয়নি। যদি ডিএসই থেকে জানতে চায়, তবে তাদের আমরা উত্তর দেব।উল্লেখ্য, গত বছরের জানুয়ারিতে বিএসইসির ৭৫৮তম কমিশন সভায় পুঁজিবাজারে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো ও কমানোর প্রমাণ পেয়ে ১৬ ব্যক্তি ও এক সিকিউরিটিজ হাউসকে চার কোটি ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সেখানে নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং, ফাইন ফুডস ও স্টাইলক্র্যাফটের সঙ্গে ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্কের শেয়ার লেনদেনে কারসাজি প্রমাণিত হওয়ায় তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।

Share this news