এখন টাকার সংকটেও ভুগছে ব্যাংকগুলো

Date: 2023-12-28 08:00:07
এখন টাকার সংকটেও ভুগছে ব্যাংকগুলো
ডলার–সংকটের পাশাপাশি দেশের ব্যাংকগুলো এখন টাকার সংকটেও ভুগছে। ফলে ব্যাংকগুলো যে হারে টাকা ধার করে, সেই হার দ্রুত বাড়ছে। অনেক ব্যাংককে উচ্চ সুদে আমানতও সংগ্রহ করতে হচ্ছে। জে৵ষ্ঠ ব্যাংকার ও খাতবিশেষজ্ঞরা তারল্যের এই সংকটের জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করছেন।এগুলো হলো—বারবার ছাড় ও সুবিধা দেওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়া, সরকারের উচ্চ সুদে টাকা ধার নেওয়া ও বেশি দামে ডলার সংগ্রহ। তারল্যসংকট মোকাবিলায় এখন ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করতে হচ্ছে।সরকারের রাজস্ব আদায় কম, তাই তারা ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে খরচ কমিয়ে আনতে হবে, নতুন প্রকল্প নেওয়া বন্ধ করতে হবে।সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংকব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর শেষে ঋণ পরিশোধে আবার ছাড় মিলবে—এমন প্রত্যাশায় অনেক ব্যবসায়ী গ্রাহক ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত না দিয়ে অপেক্ষা করছেন। পাশাপাশি সরকার উচ্চ সুদে বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করায় ব্যাংকগুলো আমানত পেতে সমস্যায় পড়ছে। অন্যদিকে ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। দুই বছর আগে যে ডলার কিনতে ৮৫ টাকা খরচ হতো, তার আনুষ্ঠানিক দরই এখন ১১০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে ১২৩ টাকাও খরচ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের থেকে পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নানা আর্থিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে। এসব ধার ১, ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি। ভালো হিসেবে পরিচিত অনেক ব্যাংকও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা নগদ জমা হিসাবের (সিআরআর) ঘাটতি পূরণে টাকার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই দ্বারস্থ হচ্ছে।পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব আদায় কম, তাই তারা ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে খরচ কমিয়ে আনতে হবে, নতুন প্রকল্প নেওয়া বন্ধ করতে হবে। সরকারি প্রকল্পগুলো যেন টাকা বানানোর যন্ত্র। আছে বিপুল অপচয়ও। এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার আমানতের সুদহারের চেয়ে কম রাখতে হবে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোটা ভুল নীতি ছিল। খেলাপিদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার মতো ভুল নীতি আর নেওয়া যাবে না। এসব করলেই তারল্য পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে।’আমানত ও ঋণ পরিস্থিতিঋণ ও আমানতের নিয়ন্ত্রিত সুদহারের ব্যবস্থা তুলে এ খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এরপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে সুদহার নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালু করে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদ ৬ শতাংশ — বহুল সমালোচিত এই ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে স্মার্ট সুদহার হিসেবে পরিচিত নতুন পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্মার্ট হলো, সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। গত জুন মাসে স্মার্ট ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, যা নভেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। স্মার্ট হারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যোগ করতে পারে। ফলে ঋণের সুদহার এখন বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।নিজস্ব তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ব্যাংকগুলোর সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা কমিটি (অ্যালকো) আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে থাকে। তারল্যসংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলোর একটি বড় অংশই এখন আমানতের ওপর ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। সংকটে পড়ে কোনো কোনো ব্যাংক এমনকি ১২ শতাংশ সুদেও তহবিল সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে। আমানতে ওপর সুদের হার বাড়ার কারণে ঘরে রাখা টাকা ব্যাংকে ফেরানোর প্রবণতা বেড়েছে। তবে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। ফলে ব্যাংকে টাকার সংকট চলছেই।রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, আমানতের বাজারে একটা খরা চলছে। সুদহার বেশ বেড়ে গেছে, এরপরও চাহিদামতো আমানত মিলছে না। অনেকে সরকারের বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। কারণ, তাতে ভালো সুদ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ঋণ আদায়ও আশানুরূপ হচ্ছে না। এ কারণে তারল্য পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক ব্যাংক। তবে আরও কিছুদিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করেন তিনি।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ব্যাংকের বাইরে থাকা মুদ্রার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, যা অক্টোবরে কমে হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। ব্যাংকিং–ব্যবস্থার বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমায় আমানত বেড়েছে ব্যাংকে। গত জুন মাসে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, যা অক্টোবরে বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। আর জুন মাসে ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, অক্টোবরে যা বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ১ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।গত অক্টোবরে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ, তবে ওই মাসে ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যদিও গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে ঋণের চেয়ে আমানত বেশি বেড়েছে। এই চার মাস সময়ে আমানত বাড়লেও সম্প্রতি শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকে আবার চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। আর এই খবর আলোচনায় আসার পর এসব ব্যাংকের আমানতে ধাক্কা লেগেছে।বাড়ছে সরকারের ধার নেওয়াটাকা ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার পর ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ধার করে চলছে সরকার। ফলে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ, ১৮২ দিন বিলের সুদহার ১১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের সুদ বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদ যেখানে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ শতাংশ, সেখানে একই সুদহারে টাকা ধার করছে সরকার। ফলে সুযোগ নিচ্ছে সবাই। ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি এখন করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিও ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করছেন। ব্যাংকের তারল্যসংকটে এটি বড় ভূমিকা রাখছে।সরকার এই সুদহারে গত রোববার ৯১ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, ১৮২ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ৪২৭ কোটি টাকা এবং ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ১৪১ কোটি টাকা ধার করেছে।বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ কাদরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের ঋণের সুদ বেশি হওয়ায় এখন ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যরাও সেখানে বিনিয়োগ করছে। এই বিনিয়োগে ব্যাংকের কোনো বাড়তি খরচ নেই, টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চিন্তাও নেই। এ জন্য তারল্য বাজারে কিছুটা ঘোলাটে পরিস্থিতি চলছে। এখন ডলারের বাজারের মতো প্রতিটি ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়া নজরদারি শুরু করতে হবে। সরকারের ঋণের সুদ কমলে তারল্য পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে।ঋণ পরিশোধে অনীহাব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের কারণে বছর শেষের আগে ছাড় দেওয়া হবে—এই আশায় অনেকে ঋণের কিস্তি দিচ্ছেন না। পাশাপাশি গত তিন বছরে কোভিড মহামারি ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতিই অনেকটা নষ্ট হয়েছে। দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ এবং তারচেয়েও বেশি পরিমাণ ঋণের কিস্তি সময়মতো আদায় না হওয়ায় সংকট দীর্ঘতর হচ্ছে।ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণ পরিশোধে অনীহার কারণেও বছর শেষে এসে ব্যাংকগুলো তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। সাধারণত প্রতিটি ব্যাংককে পরিচালনা পর্ষদ থেকে মুনাফার নির্দিষ্ট লক্ষ্য বেঁধে দেয়। ফলে ঋণ আদায় না হলেও কাগজেপত্রে মুনাফা দেখানোর চেষ্টা করছে অনেক ব্যাংক।ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় পরিস্থিতি সামলাতে টাকা ধার দেওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতে এই টাকা ধার দেওয়া হচ্ছে। এক দিন মেয়াদি রেপো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে মূলত সিআরআর ঘাটতি পূরণের জন্য। এ ছাড়া ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি টাকা ধারের পাশাপাশি বিশেষ ব্যবস্থাতেও টাকা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বাইরে সংকটে পড়া পাঁচটি ইসলামি ধারার ব্যাংককে বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে। লেনদেনব্যবস্থা সচল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বছর ধরে এসব ব্যাংককে এই সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।জানা গেছে, ব্যাংকগুলোকে গত সপ্তাহের রোববার ১৮ হাজার ৪১০ কোটি টাকা, সোমবার ১৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, মঙ্গলবার ১৯ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, বুধবার ২৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা ও বৃহস্পতিবার ১৯ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্য টাকা ধার দেওয়া ও বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে হবে। শরিয়াহ ব্যাংকগুলোতে যা চলছে, তা আর বরদাশত করা ঠিক হবে না। তাহলেই এই খাত ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে আসবে। না হলে ব্যাংক খাতই পুরো অর্থনীতিকে ভোগাবে।কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য খেলাপিদের নতুন করে আর ছাড় দিতে চাইছে না বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। যদিও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ইতিমধ্যে ছাড়ের জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। তারা গভর্নরকে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেখা করেও এই দাবি জানিয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সম্মেলনে বলেন, বছরের পর বছর নানা ছাড় দেওয়া হলেও খেলাপি ঋণ শুধু বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে, এসব ছাড় কোনো কাজে আসেনি। এখন শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে শিগগির রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, আগের মতো আর নীতি ছাড় দেওয়া হবে না।

Share this news