এক যুগেও বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি মিউচ্যুয়াল ফান্ড
মূলত ২০০৯ সাল থেকে দেশের শেয়ারবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের যাত্রা শুরু। এরপর খুব অল্প সময়ই মেয়াদী মিউচ্যুয়াল ফান্ড তার আকর্ষণ ধরে রাখতে পারে, তারপর বাজার উত্থান-পতনের সাথে কেন যেন এই সেক্টরটি তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়। ২০১০ সালের পর মহাধসের ফলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাজারের মন্দাবস্থা এবং দক্ষতার সহিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে না পারায় মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ড তার আকর্ষণ হারায়।২০১৯ সালের পর্যন্ত ৫টি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির অধীনে মোট ২৮টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মোট নিট সম্পদ মূল্য ছিল ৫৩১৬.৪০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের মধ্যে এই মিউচুয়াল ফান্ডগুলো অবসায়নে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো অবসায়নে গেলে বাজারে বড় ধরনের সেল প্রেসার হবে, এতে সার্বিকভাবে শেয়ারবাজার সূচকের নিন্মমুখি চাপ তৈরি হবে, ফলশ্রুতিতে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের সার্বিক পোর্টফলিও বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। এই ফান্ডগুলো বাজারে বিদ্যমান থাকলে শেয়ারবাজার অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের সময় এগুলো মার্কেট মেকারের ভূমিকা পালন করবে। ফলে ১০ বছর মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর মেয়াদ আইন বদলে আরও ১০ বছর বাড়ানো হয়। যার ফলশ্রুতিতে, উক্ত ২৮টি ফান্ড অবসায়নে যায়নি, উল্টো ফান্ডগুলোর মেয়াদ ১০ বছর বাড়ানো হয়েছিল। এই মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি ট্রাস্ট দলিলের পরিপন্থি।এর ফলে, একজন বিনিয়োগকারী কীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল তা তুলে ধরা হলো: ধরুন, যখন ১০ টাকা এনএভির একটা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট ৫ টাকায় ট্রেড হচ্ছিল, আমি একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে লক্ষ্য রাখতে থাকি ফান্ডগুলি ২০২১-২৩ সালের মধ্যে অবসায়ন বা বিলুপ্তিতে যাবে। সেই সখর ফান্ডগুরোতে আমি যদি দুই তিন বছর আগে বিনিয়োগ করি, তাহলে অবসায়নের আগ পর্যন্ত আমি ডিভিডেন্ড পাবো এবং সেই ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক যদি বর্তমান এনএভি ধরে রাখতে পারে, তাহলে ফান্ড অবসায়নের বছর আমি ৫০ শতাংশ ক্যাপিটাল গেইন পাবো।কিন্তু হঠাৎ করে মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মেয়াদ ১০ বছর বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে বিনিয়োগের হিসাব-নিকাশ পরিবর্তন হয়ে যায়, যেটা মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ট্রাস্ট দলিলের পরিপন্থি।যেহেতু বেশিরভাগ মিউচ্যুয়াল ফান্ড ২০০৯-২০১১ সালে মার্কেটে আসার পর ২০১০ সালে মহাধসের মুখোমুখি হয়, ফলে বেশিরভাগ ফান্ড লসের মুখোমুখি হওয়ায় বিনিয়াগকারীদের ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। যার ফলে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ মিউচ্যুয়াল ফান্ড ক্যাশ ডিভিডেন্ডের পরিবর্তে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (আরআইইউ) দিয়েছিল, যা ছিল ট্রাস্ট ডিড পরিপস্থি। আরআইইউ দেয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তখন বলা হয়েছিল ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিলে বাজার থেকে নগদ টাকা উঠে যাবে এবং বাজারে সেল প্রেসার আসবে।বাজারে যখন ১০ টাকার ইউনিটগুলো ৫ টাকা মূল্যে কেনা-বেচা হচ্ছিল, তখন ১০ টাকা ইউনিটে আরআইইউ ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে সম্পদ ব্যবস্থাপকরা ১০ টাকা ইউনিট মূল্যে ম্যানেজম্যান্ট ফি পেত, ফলে তারা লাভবান হতো, বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হতো, এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই লস সহ্য করতে হতো।২০২০ সালে বিএসইসি একটি ঘোষণা দিয়েছিল যে, মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো রিইনভেস্টম্যান্ট ইউনিট (আরআইইউ) দিতে পারবে না।কিন্তু দেখা গেল, ২০২০ সালে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৪ শতাংশ এবং বাজার মূলধন ৬৫ শতাংশ বাড়ে। কিন্তু মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো গড়ে মাত্র ২.৩৮ শতাংশ হারে ডিভিডেন্ড দেয়।আমরা যদি ২০২০ সালের মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর ডিভিডেন্ড পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখি ৩৬টি ফান্ডের বিপরীতে ২৪টি ফান্ড কোনো ডিভিডেন্ড দেয়নি। কিন্তু ২০২১ সালে ফান্ডগুলো ভালো ডিভিডেন্ড দিতে সক্ষম হয়। যেহেতু শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি ভালো ছিল।২০২২ সালে মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর’২২ প্রান্তিকে তালিকাভুক্ত ৩৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১৭টি লোকসান করেছে। এতে বুঝা যায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে দক্ষতা ও পেশাদারী মনোভাব দেখাতে ব্যর্থ হয়। বাজার ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধিতে পেশাদার নামধারী সম্পদ ব্যবস্থাপকরা যদি ১০ শতাংশ রিটার্ণ দিতে না পারেন তবে কেন মানুষ তাদের কাছে টাকা দিবে।জুলাই ২০২২ পর্যন্ত কয়েকটি দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপকদের তথ্য অনুযায়ী ভারতের ৪৩ সম্পদ ব্যবস্থাপক মিলে ৪৭২ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে ২১ সম্পদ ব্যবস্থাপক মিলে ৬.৩৬ বিলিয়ন ডলার ব্যবস্থাপনা করে। বিপরীতে, আমাদের ৫৪ সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান মিলে ১.৬০ বিলিয়ন ডলার ব্যবস্থাপনা করে।এরআগে মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ড গ্রামীণ-১ স্ক্রিম টু রূপান্তর ইস্যুতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এসেট অ্যান্ড ইনভেস্টম্যান্ট ম্যানেজম্যান্ট সার্ভিস অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (এইমস) রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফান্ডটি অবসায়ন প্রক্রিয়াটি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারী বিনিয়োগের মাধ্যমে মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের তহবিলে ঝুঁকিতে পরার সঙ্কায় ডেল্টা ও ডিবিএইচ প্রথম মিউচ্যুয়াল ফান্ড সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ এসেট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি বিনিয়োগ বাতিল করতে ট্রাস্টিকে চিঠি দেয় দুই তৃতীয়াংশের বেশি ইউনিটধারী। সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে, ফান্ডের এক-তৃতীয়াংশ ইউনিটধারী চাইলে, ট্রাস্টির অনুমোদন সাপেক্ষে, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি পরিবর্তন করতে পারে। এর আগে সন্ধানী লাইফ ইউনিট ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক একই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন করা হয়।এমন পরিস্থিতিতে বিএসইসি সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নুতন শর্ত বা বিধান আরোপ করতে যাচ্ছে। সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি কর্তৃক ব্যবস্থাপনা ফি দাবি করার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা ফি দাবি করতে পারবে।