দুই মিলিয়নের পথে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, রিজার্ভেও সুখবর
![দুই মিলিয়নের পথে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, রিজার্ভেও সুখবর](https://stocknewsbd.s3.ap-southeast-1.amazonaws.com/6314/dollarr.jpg)
রমজান মাসে বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। যে কারণে রেমিট্যান্সপ্রবাহে ফের গতি ফিরেছে।চলতি মার্চ মাসের ২৪ দিনেই ১৬০ কোটি (১.৬০ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক ফেব্রুয়ারি মাসের পুরো সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।চলতি মাসের বাকি ৭ দিনে এই হারে রেমিট্যান্স আসলে ছয় মাস পর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে ২০৭ কোটি (২.৭ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে।রেমিট্যান্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৭ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এই হিসাবে টাকার অঙ্কে এই ২৪ দিনে ১৭ হাজার ১২০ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটি প্রবাসী। প্রতিদিন গড়ে এসেছে ৬ কোটি ৬৬ লাখ ডলার বা ৭১৩ কোটি টাকা।সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আট মাস ২৪ দিনে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ) ১ হাজার ৫৬১ কোটি ৯ লাখ (১৫.৬১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে চেয়ে সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি।২৪ মার্চ থেকে রমজান মাস (চাঁদ দেখা সাপেক্ষে) শুরু হয়েছে। রোজায় প্রতিবারের মতো এবার বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২২ অথবা ২৩ এপ্রিল দেশে ঈদ উদযাপিত হবে। ঈদকে সামনে রেখে আরও বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে বলে আশা করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। সে হিসাবে এপ্রিল মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে বলে মনে করছেন তারা।টানা তিন মাস বাড়ার পর ফেব্রুয়ারিতে হোঁচট খায় রেমিট্যান্স। ওই মাসে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। তার আগের তিন মাস- নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে এসেছিল যথাক্রমে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ, ১৬৯ কোটি ৯৭ লাখ এবং ১৯৫ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিন হওয়ায় ওই মাসে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছিল বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।তবে মার্চ মাসে এই সূচকে ফের গতি ফিরেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল সোমবার রেমিট্যান্সপ্রবাহের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, এই মাসের প্রথম ২৪ দিনে ১৫৯ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার ডলারের যে রেমিট্যান্স এসেছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৯ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ৫৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১৩৬ কোটি ১৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। আর ৯টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার।বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ফেব্রুয়ারিতে এই সূচক চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম এসেছিল। তবে গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি ছিল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। তবে বেশ উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর; প্রথম মাস জুলাইয়ে ২১০ কোটি (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার। পরের মাস সেপ্টেম্বরে হোঁচট খায়, এক ধাক্কায় নেমে আসে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। অক্টোবরে তা আরও কমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে নেমে আসে।পরের তিন মাস টানা বেড়েছে, নভেম্বরে আসে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে আসে ১৭০ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে আরও বেশি, ১৯৬ কোটি ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা বেশ কমে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলারে নেমে এসেছে।২০২০-২১ অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।গত ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স কমার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘প্রতিবছরই ফেব্রুয়ারি মাসে অন্যান্য মাসের চেয়ে রেমিট্যান্স কিছুটা কম আসে। এর কারণ, ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে শেষ হয়।’ এখন রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই রোজা ও দুই ঈদে রেমিট্যান্স বাড়ে; রোজা ও ঈদ উৎসবকে সামনে রেখে প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের বাড়তি প্রয়োজন মেটাতে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। এবারও তাই হচ্ছে।’ কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চলতি অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও রেমিট্যান্স বাড়বে জানান তিনি।ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় বেশি টাকা পাওয়ায় মাঝে কয়েক মাস প্রবাসীরা অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানোয় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডির বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ছে বলে মনে করছেন মেজবাউল হক।অর্থনীতির গবেষক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সই কিন্তু সংকট সামাল দিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি টাকা পাওয়ায় প্রবাসীরা অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোয় মাঝে কয়েক মাস রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় এখন বাড়ছে। এই ধারা যদি জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে তাহলে অর্থবছর শেষে ৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হবে। বর্তমান পেক্ষাপটে তা অবশ্যই ভালো।’তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স যদি না বাড়ত তাহলে কিন্তু রিজার্ভ আরও কমে যেত; অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়ত। তাই রিজার্ভ যাতে আর না কমে যায়, সে জন্য রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও কম সুদের বিদেশি ঋণ বাড়ানোর দিকেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে।’এদিকে, রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রির পরিমাণও কমছে। আর এতে রিজার্ভের ওপর চাপ কমছে। বাড়তে শুরু করেছে এই রিজার্ভের সূচক।সোমবার দিন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। গত ৭ মার্চ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের ১ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। রেমিট্যান্স বাড়ায় গত কয়েক দিনে তা বেড়ে ৩১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।অন্যদিকে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিতে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আট মাস ২৭ দিনে (২০২২ সালে ১ জুলাই থেকে ২৭ মার্চ) ১০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে।এর আগে কোনো অর্থবছরের (১২ মাস) পুরো সময়েও রিজার্ভ থেকে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। তবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির পরিমাণ গত তিন মাস ধরে কমছে।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোর চাহিদা মেটাতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ থেকে ১ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। অক্টোবরে বিক্রি করা হয় আরও বেশি ১ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বরে তা কিছুটা কমে ১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ডিসেম্বরে তা ফের বেড়ে ১ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন বিক্রি করা হয়। একক মাসের হিসাবে যা রেকর্ড; এর আগে কখনোই এক মাসে রিজার্ভ থেকে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি।এরপর থেকে অবশ্য বিক্রি কমছে। জানুয়ারিতে বিক্রি করা হয় ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে নেমে আসে ১ বিলিয়নের নিচে; বিক্রি হয় ৯২ লাখ ৪২ হাজার ডলার। আর চলতি মার্চ মাসের ২৭ দিনে অর্থাৎ গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৭০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে।