বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’য়ের অভিযোগ

Date: 2022-10-18 11:00:13
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’য়ের অভিযোগ
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’য়ের অভিযোগ উঠেছে। বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের গোপন তথ্য জেনে তিনি কোম্পানিটির সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জানতে পারেন এমন ব্যক্তিদের অন্যতম। তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া বেগম বে-লিজিংয়ের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক, পরিচালক তারিক সুজাত ভাগনে আর পরিচালক জুবায়ের কবির তাঁর ভাতিজা। স্বতন্ত্র পরিচালক জাইদি সাত্তার সাউথইস্ট ব্যাংক ফাউন্ডেশনের পরিচালক। আবার শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বে-লিজিংয়ের ইভিপি এম মনিরুজ জামান খান সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক।আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ অর্থবছরের নিরীক্ষিত প্রতিবেদন প্রকাশের আগে নিজের হিসাব থেকে তিনি কোম্পানিটির সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এভাবে শেয়ার বেচে আলমগীর কবির প্রায় আড়াই গুণ মুনাফা তুলেছেন। সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস থেকেও প্রচুর শেয়ার বিক্রির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বে-লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদনের যথার্থতা এবং ইনসাইডার ট্রেডিং নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এই বিষয়ে তদন্তে নেমেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে প্রথম ধসের সময় আলমগীর কবির বিএসইসির সদস্য ছিলেন। তিনি কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে অপসারণ করা হয়। আলমগীর কবির বর্তমানে সাউথইস্ট ব্যাংকের পাশাপাশি সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসেরও চেয়ারম্যান। কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক, শীর্ষ কর্মকর্তাসহ তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যরা ইনসাইডার হিসেবে বিবেচিত হন।বিএসইসি সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, বে-লিজিংয়ের অন্যতম ইনসাইডার হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগে জেনে আলমগীর কবির এবং তাঁর স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করেছেন।এছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংক এবং ব্যাংকটির মালিকানাধীন সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস বে-লিজিংয়ের শীর্ষ শেয়ারহোল্ডার। ২০১০ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংক এবং সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস বে-লিজিংয়ের প্রায় ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল। বর্তমানে সাউথইস্ট ব্যাংকের মালিকানায় আছে ১ কোটি ৪০ লাখ ১২ হাজার ৪০৫টি শেয়ার, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।বে-লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ি, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন প্রান্তিকে বা ৯ মাসে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল প্রায় ৩৯ কোটি টাকা বা শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশের আগে মুনাফার এই তথ্যই সাড়ে ১০ মাস ধরে জানতেন শেয়ারহোল্ডাররা।তবে পুরো অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর জানা যায়, শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর’২১) কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা বা শেয়ার প্রতি লোকসান ৯৯ পয়সা। প্রথম ৯ মাস ধারাবাহিক মুনাফা করার পর শেষ তিন মাসে তার চেয়েও বড় অঙ্কের লোকসান বিএসইসির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়েছে।সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা লোকসানের এই তথ্য চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জানলেও ইনসাইডারদের এই তথ্য জানার সুযোগ ছিল গত ডিসেম্বরের পর থেকেই। কোম্পানিটির অধোগতির গোপন এই তথ্য জেনে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বে-লিজিংয়ের অন্যতম প্রধান শেয়ারহোল্ডার সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস ১ কোটি ৩৬ লাখ শেয়ার থেকে ১ কোটিরও বেশি বিক্রি করেছে।কবির তাঁর ব্যক্তিগত বিও হিসাবে থাকা প্রায় ৪০ লাখ শেয়ারের সবটাই বিক্রি করে দিয়েছেন। বে-লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদনের সীমাহীন এই অসঙ্গতি খতিয়ে দেখতে গত ২২ সেপ্টেম্বর নিয়ন্তক সংস্থা বিএসইসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রান্তিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য যাচাই করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে কোনো ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখতে বলা হযেছে।বিএসইসির একটি সূত্র মতে জানা গেছে, বে-লিজিংয়ের ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে এমন প্রাথমিক তথ্য জেনেই কমিশন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সব ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর কাছে এই সম্পর্কিত কোনো তথ্য থাকলে তা জানাতে চিঠি দিয়েছে।প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নিজের নামে থাকা বে-লিজিংয়ের সব শেয়ার আলমগীর কবির বিক্রি করেছেন গত এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে। এসব শেয়ার তিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ধারণ করেছিলেন। এখন তাঁর বিও হিসাবে বে-লিজিংয়ের একটি শেয়ারও নেই।অন্যদিকে, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসের নামে বে-লিজিংয়ের ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬৫ হাজার ২০৯টি শেয়ার ছিল। এখন আছে মাত্র ৩০ লাখ শেয়ার। গত জানুয়ারিতে মার্চেন্ট ব্যাংকটি ৪১ লাখ ৫৫ হাজার এবং ফেব্রুয়ারিতে ৬১ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার প্রায় ৩৫ কোটি টাকা মূল্যে বিক্রি করেছে।শেয়ারবাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে বে-লিজিংয়ের শেয়ারটির দাম সর্বোচ্চ ৩৭ টাকায় উঠেছিল। এরপর থেকে ক্রমাগত পতন হয়েছে। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার ২৩ টাকা ৯০ পয়সায় ফ্লোর প্রাইসে দিনের পর দিন বিক্রেতাশুন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফ্লোর প্রাইস না থাকলে শেয়ারটির দাম আরও অনেক কমার শঙ্কাও ছিল।

Share this news