৭১ টাকা দায়ে থাকা শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস ৯৭৮ টাকা
দেশের পুঁজিবাজারে প্রকৌশল খাতের কোম্পানি রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কো (বিডি) লিমিটেডের শেয়ারদর বর্তমানে ফ্লোর প্রাইস ৯৭৮ টাকা ৩০ পয়সায় অবস্থান করছে। কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ২ কোটি টাকা। যে কারণে কোম্পানির রিজার্ভ, ব্যবসা, সম্পদ সবকিছু লোকসানে থাকার পরও এর শেয়ার নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে কারসাজি। ফলে কোম্পানির শেয়ারদর গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর কারসাজির মাধ্যমে দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩৯৫ টাকা ৯০ পয়সায় উঠানো হয়। এরপর আবার একাধিকবার কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দর চলতি বছরে ১১৪৯ টাকা ৩০ পয়সায় পৌঁছে।কোম্পানির ব্যবসা না থাকা বা লোকসানে থাকার পরও শেয়ারদরের এ চিত্রকে বড় ধরনের কারসাজি বলে জানান বাজার-সংশ্লিষ্টরা। কোম্পানি স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের হওয়ায় কারসাজি চক্র বড় ধরনের কারসাজি প্রতিনিয়ত করে আসছে। সেই সঙ্গে প্রাইমারি নিয়ন্ত্রক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শুধু জানতে চাওয়া ছাড়া কোনো তদন্ত করেনি এবং প্রধান নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার সুযোগে কারসাজি চক্র বিনিয়োগকারী বড় ক্ষতি করেছে বলে জানান তারা।কোম্পানিটির শেয়ারদরের চিত্র থেকে দেখা যায়, গত বছর বেশি কিছু সময় শেয়ারটির দর ফ্লোর প্রাইসে ছিল। পরে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার পর শেয়ারদরে পতন হয় এবং শেয়ারটির দর কমে ৭৩৫ টাকা ৯০ পয়সায় নেমে আসে। এরপর থেকেই শুরু হয় কারসাজি। উত্থান-পতনের মাধ্যমে শেয়ারদর ১৩৯৫ টাকা ৯০ পয়সায় নেয়া হয় এবং প্রথম ধাপের কারসাজি শেষে দর পতনের মাধ্যমে ৮৮৯ টাকায় পৌঁছে। পরে দ্বিতীয় ধাপে কারসাজি শুরু হলে একই বছর ডিসেম্বরে শেয়ারটির দর ১২৩৫ টাকা পর্যন্ত উঠানো হয়। আবার পতন হয় শেয়ার দরের, এতে দর এসে দাঁড়ায় ৮২৯ টাকা ১০ পয়সায়।এরপর চলতি বছরে কারসাজি শুরু হলে শেয়ারটির দর জুন মাসে ১১৪৯ টাকা ৩০ পয়সায় নেয়া হয়। একই মাসে ডিএসই শেয়ারদর ও লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে কারসাজি শেষে দর কমতে থাকে। পরবর্তীতে শেয়ারদর কমা ও বৃদ্ধির মাধ্যমে বড় পতন হয়। ফলে শেয়ারটি বর্তমানে ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে, এতে শেয়ারটির দরে বড় পতন থেমে আছে বলে জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। যদি ফ্লোর প্রাইস না থাকত তবে শেয়ারটির দর আরও পতন দেখা যেত এবং বিনিয়োগকারীরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে জানান তারা।অপরদিকে কোম্পানির শেয়ার লেনদেন চিত্রে দেখা যায়, গত বছর কারাসাজি শুরু হওয়ার আগে কোম্পানির শেয়ার সর্বোচ্চ লেনদেন হয় কয়েকশ করে। কিন্তু কারসাজির সময় এর শেয়ার লেনদেন বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজারের উপরে। এবং যখন সর্বোচ্চ দামে পৌঁছে তখন শেয়ারটির লেনদেন ছিল ২১ হাজার ৫৮৬টি। এরপর কারসাজি শেষে শেয়ার লেনদেন শতকের ঘরে নেমে আসে।দ্বিতীয়বার কারসাজি শুরুর ক্ষেতেও একই চিত্র দেখা যায়। চলতি বছরের কারসাজির সময়ও একইভাবে শেয়ারটির লেনদেন বৃদ্ধি পায়। এতে শেয়ার লেনদেন পৌঁছে ১১ হাজার ৯৮২টি এবং ডিএসই জানতে চাইলে কারসাজি শেষে শেয়ার লেনদেন পুনরায় একশ’র নিচে নেমে আসে।কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালের পর থেকে কোম্পানি কোনো লভ্যাংশ দেয় না। কোম্পানি গত ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ হিসাব বছরসহ চলতি ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকেও শেয়ারপ্রতি লোকসানে রয়েছে। একই সঙ্গে কোম্পানিটি চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে শেয়ার প্রতি ৭১ টাকা ৪৫ পয়সা দায় (লোকসান) রয়েছে। এছাড়া কোম্পানির রিজার্ভ ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণাত্মক রয়েছে।বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা মাত্র ২০ লাখের মধ্যে লেনদেনযোগ্য শেয়ার হচ্ছে ১০ লাখেরও কম। ফলে কারসাজি চক্র অল্প কিছু শেয়ারে দাম বাড়িয়ে দিলেই প্রভাব পড়ে এবং শেয়ারটির দর অনেক বাড়বে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে দিলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ফলে কারসাজি চক্র শেয়ারটির দর বাড়িয়ে মুনাফা করে বের হয়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শেয়ারটির দর হাজারের ওপরে হওয়ায় অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যায়।তারা বলছেন, ডিএসই শুধু জানতে চাওয়া ছাড়া নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত করে না। যদি বিএসইসির নজরে আসে এবং পদক্ষেপ নেয়, তখন ডিএসইকে তদন্ত করতে দেখা যায়। ফলে তাদের নজরে কারসাজিকারী ধরা না পড়লে কিছুই হয় না। ঠিক তেমনি এ শেয়ারটি নিয়ে প্রতিনিয়ত কারসাজি হয়ে আসছে, কিন্তু ডিএসইর শুধু জানতে চাওয়া ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। ফলে ফ্লোর প্রাইসে আটকে বড় পতন থেকে বিনিয়োগকারীরা বেঁচে গেলেও, যখন তুলে দেয়া হবে তখন বিনিয়োগকারীর বড় ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছেন তারা।এ বিষয়ে বর্তমান অবস্থা ও পরিশোধিত মূলধন বৃৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির সচিব খাদিজা সুলতানা শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা পরিশোধিত মূলধন বাড়াব। এজন্য প্রথমে অনুমোদিত মূলধন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরপর পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো হবে। লোকসান কাটানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এজন্য বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে সেটা এখনি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হতে সময় লাগবে। ব্যবসার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে লোকসান কমে আসবে বলে জানান তিনি।শেয়ার দরে কারসাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শেয়ারদর বা লেনদেনের বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই। কোম্পানির শেয়ারদর ও লেনদেনের বিষয়ে ডিএসই থেকে কিছু জানতে চাওয়া হলে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়। একইভাবে কোম্পানির শেয়ারদর বা লেনদেনের অস্বাভাবিক বিষয়ে কোনো তথ্য জানা নেই এবং বর্তমানে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।